ক্যাটাগরি: ছাত্র মজলিস প্রাথমিক সিলেবাস ছাত্র মজলিস কর্মী সিলেবাস

বাংলদেশে ছাত্র আন্দোলন: ইসলামী ছাত্র মজলিস

বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৫৮

বর্ণনা

বাংলদেশে ছাত্র আন্দোলন: ইসলামী ছাত্র মজলিস

 

আবদুল কাদির সালেহ

 

প্রকাশনায়
আইসিএম পাবলিকেশন্স
২/২, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৩১৮৩২৭

বাংলদেশে ছাত্র আন্দোলন: ইসলামী ছাত্র মজলিস

 

১ম সংস্করণ ও প্রকাশ
রবিউস সানি -১৪৪৭
ভাদ্র-১৪৩২
অক্টোবর-২০২৫                                      

 

প্রকাশনায়
আইসিএম পাবলিকেশন্স
২/২, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৩১৮৩২৭

মূল্য: ৫০.০০ (পঞ্চাশ) টাকা মাত্র

 

Bangladeshe Chhatra Andolon: Islami Chhatra Majlish
Published by ICM Publications
Central Office: 2/2, Purana Paltan, Dhaka-1000
Phone: 01711-318327, Price: TK. 50.00 Only

বাংলদেশে ছাত্র আন্দোলন: ইসলামী ছাত্র মজলিস

ভূমিকা


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বাঙ্গালা থেকে সুবে বাঙলা ও বঙ্গ। বঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলা। পূর্ববাংলা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে এখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই বদ্বীপে জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও ভাষার ইতিহাস হাজার দিয়ে পরিমাপযোগ্য। মক্কা-মদীনাকেন্দ্রিক ইসলামের বিস্তৃত যুগেই তাবে-তাবেঈনদের প্রত্যক্ষ পদচারণায় এই জনপদ ইসলামের সংস্পর্শে আসে। প্রথম সহস্রাব্দের একেবারে গোড়াতেই ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু খেলাফতে ইলাহিয়ার আদলে এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পতাকা ওড়েনি। যদিও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভেতর দ্বীনী তাকিদ এবং বিজয়ী-আদর্শ হিসেবে ইসলামকে পাবার আকুতির কোন শেষ ছিলো না।


এরই ফলশ্রুতিতে সাধারণ জনতার ভেতর জন্মালো দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা। পীর-মাশায়েখ, ওলী-আল্লাহ এবং আলেমে দ্বীনের বিরামহীন দাওয়াতী কাজ এই ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করে। সৃষ্টি হয় ইসলামী আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা। শহীদ-গাজীর রক্তরেখা বেয়ে নানাভাবে বহুমাত্রিক আদলে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রবলতর হতে থাকে। দ্বীনের প্রতিষ্ঠা এবং আজাদীর লড়াই সমান্তরাল এগিয়েছে বহুদিন।


প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীনের সাথে যোগ দেন দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাথে বঞ্চিত-নিপীড়িত ভাগ্যহত জনতা। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম এই জনপদে এই জনগোষ্ঠীর আখেরাতের নাজাতের সাথে আজাদী তথা মুক্তির নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা হাজার হাজার দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বলে ওঠে দ্বীন ইসলামের লাল মশাল।


এই মশাল হাতে তুলে নেয় তারুণ্যের প্রতীক, জিহাদী প্রেরণার নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র ছাত্র সমাজ। গড়ে ওঠে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা। খানকাকেন্দ্রিক, দ্বীনী প্রতিষ্ঠানমুখী, এমনকি সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেও জন্ম নিতে থাকে হাজারো তারুণ্যদীপ্ত প্রাণ।


ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্র সমাজের ভেতর গড়ে ওঠা দ্বীনের পথে এই তারুণ্যের কাফেলা এক সময় সমন্বিতভাবে সামনে কদম বাড়ায়, আবার সময়ের প্রয়োজনে আলাদা আলাদা ক্ষেত্র ও মেজাজে গড়ে ওঠে- ছাত্র ফ্রন্ট, যুব ফ্রন্ট, কৃষক, শ্রমিক, মজদুর, মেহনতী জনতার আলাদা আলাদা ফোরাম। এরই বর্তমান স্বীকৃত রূপ ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের স্বতন্ত্র ফোরাম।


এটা যেনো সমন্বিত বিভাজন; আনুগত্যের এককেন্দ্রিকতার ভেতর কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে সুবিধাজনক বিন্যাস। যেমনটি একটি জিহাদের একটি ময়দানে একজন সেনাপতির নির্দেশে বিভিন্ন বাহিনীর আলাদা আলাদা ব্যুহ রচনার উদাহরণ।


আলোচ্য পুস্তিকাটি এই দেশে প্রচলিত ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের ঐতিহ্যিক ধারায় বিকশিত, এক সময়ের একজন ছাত্র কর্মী যিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটি কাফেলার নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিলেন, আজকের সেই পরিণত পুরুষ একজন প্রাজ্ঞ দ্বীনী আলেম। বিভিন্ন সময়ে রচিত তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধের সমষ্টি ও গ্রন্থ। সময়ের বিবেচনায় একটি নিবন্ধ আরেকটি থেকে আলাদা। মেজাজ ও লক্ষ্যের সাযুজ্য এবং প্রেরণার উৎস অভিন্ন বটে, কিন্তু কোনটা অপেক্ষাকৃত পরিণত মেজাজে রচিত আঁট-সাঁট, কোনটায় শিথিল উপস্থাপনার প্রেক্ষিত বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে।


লেখক একজন সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, বর্তমানে বিলাতপ্রবাসী একজন দা’ঈ, কমিটেড লেখকও বটে। আজ যদি তাঁকে একসাথে লেখাগুলো সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে বাক্য-বিন্যাস, শব্দচয়ন, বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তিনি হয়তো অধিকতর সমৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ছাপ রাখতেন। লেখক মাত্রই প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিশীলিত করেন। এই ক্ষেত্রে প্রকাশকরা লেখককে সেই সুযোগ দিতে না পেরে হয়তো অতৃপ্ত। একজন পাঠক হিসেবে আমি কিন্তু তুষ্ট। কারণ গ্রন্থিত নিবন্ধগুলোর বিষয়বস্তুর মান সময়গণ্ডির ঊর্ধ্বে।


লেখককে খুব কাছ থেকে জানার সুবাদে তার প্রাপ্য বিশেষণগুলোর প্রতি সংযম প্রদর্শনে আমি কৃপণ থাকলাম। আমার বিশ্বাস, একসাথে এতগুলো অথচ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের সমৃদ্ধ ও প্রয়োজনীয় লেখা পেয়ে ছাত্র-কর্মীরা তো বটেই অধিকন্তু সকল পাঠক আমার সংযমকে উপেক্ষা করেই বলবেন; অনেক আগেই এই ধরনের প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিলো।


আমার ধারণা ইসলামী সাহিত্য বলে যে কথাটি বোঝাবার চেষ্টা করা হয়-সেই ক্ষেত্রে বইটির আবেদন কালোত্তীর্ণ। ভাষার সাবলীলতা এবং ঋজু ভাষার উপস্থাপনার জন্য প্রতিটি নিবন্ধই পাঠককে খানিকটা হলেও সমৃদ্ধ ও আলোকিত করবে। দিক-নির্দেশনার সাথে বাড়তি দেবে আত্মবিশ্বাসও।
আল্লাহ লেখকের কলমকে আরো শক্তিমান ও গতিশীল করে দিন, প্রকাশকদের মহৎ উদ্দেশ্যকে কবুল করুন।

 

মাসুদ মজুমদার
ঢাকা, ১২ এপ্রিল ২০০০

 

 

 


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ

 

কুরআন-হাদীসের আলোকে ছাত্র মজলিসের চার দফা কর্মসূচি:
আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সুদৃঢ় অঙ্গীকারেই ছাত্র মজলিসের আবির্ভাব। একথা সত্য যে, এ কাজ শুধুমাত্র শ্লোগান, বক্তৃতা বা নিজস্ব মনগড়া কোন পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। এর জন্য যেমন প্রয়োজন এক বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচি, আল্লাহর রাহে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ কর্মীবাহিনী, তেমনি প্রয়োজন কুরআন এবং হাদীসসম্মত কর্মপন্থা। আল-কুরআন ঘোষণা করেছে:


لَقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِىۡ رَسُوۡلِ اللّٰهِ اُسۡوَةٌ حَسَنَةٌ 

“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব: ২১)

 

সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পরিপূর্ণ সফলতার জন্য প্রয়োজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শানুযায়ী কর্মসূচি। যারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চলে, কর্মসূচি গ্রহণ করে তা নিঃসন্দেহে এক মারাত্মক গোমরাহী।


وَمَنْ أَضَلَّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ

“তার চাইতে অধিকতর বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে যারা আল্লাহর হেদায়েত বাদ দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো চলে?” (সূরা কাসাস: ৫০)

 

ইসলামী ছাত্র মজলিসের চার দফা কর্মসূচিও গৃহীত হয়েছে তাই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে। কারণ সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার, জুলুম ও খোদাদ্রোহিতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছাত্র মজলিসের লক্ষ্য। নিম্নে ইসলামী ছাত্র মজলিসের চার দফা কর্মসূচির বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ

প্রথম দফা কর্মসূচি: দাওয়াত
“ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা, তাদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞানার্জনে উৎসাহ সৃষ্টি এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।”


এ আহ্বান হবে নিছক ইসলামের প্রতি তথা আল্লাহর দিকে; সংগঠন, ব্যক্তি, দল অথবা জাগতিক বা বস্তুগত চাকচিক্যময় কোন প্রকার সফলতার প্রতি নয়। ইসলামের দিকে আহ্বান তথা ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ হচ্ছে একজন মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। নবী-রাসূলগণ এ পথেই মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশ:

بَاتِهَا الرَّسُولُ بَلَغَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَتِكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَغَتَ رِسَالَتَهُ

“হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। আর যদি তা না কর তাহলে পৌছিয়ে দেয়ার ‘হক’ তুমি আদায় করলে না।’ (সূরা মায়েদা : ৬৭)


ছাত্র মজলিসের কর্মীদের প্রধান কাজ হচ্ছে ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌছানো, ইসলামী জ্ঞানার্জন এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।


    ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছানো
ছাত্রদের কোমল মন সাধারণভাবে অন্যায় ও আপোষকামিতা মুক্ত এবং সত্যানুসন্ধিৎসু থাকে। তাই ইসলামের সুমহান সৌন্দর্যের আহ্বান সহজেই তাদেরকে আকৃষ্ট করে। ছাত্ররা সমাজের অগ্রসর শ্রেণীর প্রতিনিধি ও ভবিষ্যত নির্মাতা। তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে সমাজে ইসলাম বাস্তবায়ন সহজ ও ত্বরান্বিত হবে।


طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا فلولا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ ل قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

“কিন্তু এরূপ কেন হলো না যে, তাদের অধিবাসীদের প্রত্যেক অংশ থেকে কিছু লোক বেরিয়ে আসতো এবং দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজ নিজ এলাকার জনগণকে সাবধান করতো যেন তারা অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে।” (সূরা তাওবা: ২২)


প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য ইসলামের আহ্বান অপরের কাছে পৌঁছানো। কারণ কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।


ادعُ إِلى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلُهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

“আল্লাহর পথে আহ্বান করো হিকমত ও উত্তম নসীহতের দ্বারা। আর তাদের নিকট সর্বোত্তম যুক্তি পেশ কর।”


আয়াতে ‘উদয়’ শব্দ দ্বারা নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ নির্দেশ সবার জন্য প্রযোজ্য। নিজ নিজ সুযোগ, সামর্থ্য ও যোগ্যতার সদ্ব্যবহার করে ‘দাওয়াতে দ্বীনের’ কাজ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয-অবশ্য করণীয়।


بَايُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيَّا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا منيرا

“হে নবী! নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি দ্বীনের ব্যাপারে সাক্ষ্যদাতা, বেহেশতের সুসংবাদদাতা ও আখেরাতে শাস্তির ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে এবং আল্লাহর নির্দেশে তার পথে আহ্বানকারী এবং হেদায়াতের দীপ্তিময় আলোকবর্তিকা হিসেবে।” (সূরা আহযাব: ৪৫-৪৬)


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আল্লাহর পথে আহ্বানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর হুবহু অনুসরণ প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য।


اطيعوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

“তোমরা আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের অনুসরণ করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা ‘উলিল আমর’ তাদের।”


দাওয়াতে দ্বীনের কাজকে নবী জীবনের অন্যতম প্রধান কাজরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে: 


قُلْ هُذِهِ سَبيلِي ادْعُوا إِلَى اللهِ

“হে নবী! বল, এই আমার পথ, আমার কাজ হলো আল্লাহর দিকে আহ্বান করা।” (সূরা ইউসুফ: ১০৮)


আল-কুরআন তাই দাওয়াত দানকারীর কথাকে সর্বোৎকৃষ্ট আখ্যায়িত করেছে।


وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ

“তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে? যে আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকে এবং ‘আমলে সালেহ’ করে ও বলে যে আমি মুসলিম।” (সূরা হা-মীম সিজদা: ৩৩)


হাদীসেও দাওয়াতে দ্বীনের কাজ সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর মর্যাদা ও পুরস্কার এবং এ দায়িত্ব পালন না করার পরিণতিও বর্ণিত হয়েছে।


হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত:


     نصر الله امْرًا سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَغَهُ كَمَا سَمِعَهُ

“আল্লাহ তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করুন যে ব্যক্তি আমার কাছ থেকে কোন কথা শুনেছে এবং হুবহু তা অপরের কাছে পৌছিয়েছে।” (তিরমিযী)


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত:
“একটি মাত্র কথা হলেও আমার নিকট থেকে তা অন্যের কাছে পৌঁছাও।” (বুখারী শরীফ)
ইসলাম হচ্ছে চিরসত্য, সুন্দর ও কল্যাণের আদর্শ। ইসলাম বিমুখতাই মানব সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতির মূল কারণ। তাই সামগ্রিক বিপর্যয় ও ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ও মানবতাকে সুরক্ষার জন্য দ্বীনে হকের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে হবে।


আল-কুরআনের সূরা আসরে বলা হয়েছে-


وَالْعَصْرِ - إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ - إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ وتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَا صُوا بِالصَّبْرِ

“কালের শপথ! মানুষ নিঃসন্দেহে ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত। একমাত্র ঐ সমস্ত লোক ছাড়া, যারা ঈমানদার, সৎকর্মশীল এবং সত্যের বাণী ও ধৈর্য-সহনশীলতার আহ্বান পৌছায়।”


ইসলামী ছাত্র মজলিসও তাই দ্বীনী তাগিদ এবং অনুভব থেকেই দাওয়াতে দ্বীনের কাজকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ঈমানী কর্তব্য বলে মনে করে। তাই আমাদের প্রথম দফা কর্মসূচির প্রধান দিক হচ্ছে ‘ছাত্র সমাজের’ কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।


    ইসলামী জ্ঞান অর্জন
ইসলাম জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। মূর্খতা হেদায়াতের পথে অন্তরায়- মানুষকে সত্যোপলব্ধি করতে দেয় না। অনেকেই না জেনে-বুঝে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেন। অথচ ইসলাম এক কল্যাণকর পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করা মূর্খতা। তাই কুরআন বলছে:


قُل هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

“বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?” (সূরা যুমার: ৯)
না, তারা সমান নয় কখনও। তাই ইসলাম জ্ঞানার্জন করতে নির্দেশ প্রদান করেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা.)-এর প্রতি প্রথম ওহী: 


اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

“পড়! তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক: ১) তাইতো সুদূর চীন দেশে গিয়ে হলেও ‘ইলম’ বা দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের জন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তাঁর নবীকেও এ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন।


الَّذِي بَعَثَ فِي الأَمينَ رَسُولاً مِنْهُم يَتْلُوا عَلَيْهِمْ أَيْتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ هُوَ الَّذِي فِي وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَيْلٍ مُّبِينِ

“তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি উম্মীদের মধ্য থেকে তাদের জন্য রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদেরকে আয়াতসমূহ শোনান, পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ এর পূর্বে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।” (সূরা যুমার: ২)


সকল প্রকার গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ‘কিতাবের ইলম’ বা ইসলামের জ্ঞান জানা অপরিহার্য। এজন্য নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।


الَّذِي خَلَقَ السَّمَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِنَةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى العرش الرحمن فسئل به خبيرا

“যিনি আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ‘আরশ’ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দয়াময় সেই প্রভু সম্পর্কে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর।” (সূরা ফুরকান: ৫৯)


এই আয়াতে “ফাসআল” শব্দ দ্বারা জ্ঞানার্জন করতে বলা হয়েছে।
এই জ্ঞানার্জন হচ্ছে কল্যাণকর ও অধিকতর ভাল কাজ। এর দ্বারাই আল্লাহর পরিচয়, তার সৃষ্টিকুশলতা, তার বিধানের অনুপম সৌন্দর্য, কল্যাণকারিতা, প্রকৃত হেদায়াত ও মুক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এ ‘দ্বীনী ইলম’ অর্জনের তাওফীক আল্লাহ যাকে দেন সে প্রকৃতই সৌভাগ্যবান।


عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ أَنَّ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ يُرِدِ اللَّهُ خَيْرًا تُفَقَهُهُ فِي الدِّينِ

“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ যাকে কল্যাণ দান করতে ইচ্ছে করেন তাকে দ্বীনের পূর্ণ জ্ঞান ও সমঝ দান করেন।”


তাই আল্লাহর পথে এই কল্যাণ প্রাপ্তির কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।


تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى

“তোমরা ভাল এবং তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর।”


এ পথে অপরকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাতিলের অসারতা তুলে ধরতে হলে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক ‘ইলম’ অর্জন করতে হবে।
    ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের দায়িত্বানুভূতি     জাগ্রত করা
ইসলাম নিছক ধর্মমাত্র নয়। এ এক ‘মোকাম্মাল শরীয়ত’ বা পরিপূর্ণ জীবন বিধান।


إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامِ

“নিঃসন্দেহে জীবন বিধান হিসেবে একমাত্র ইসলামই আল্লাহর নিকট মনোনীত।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৯)


বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে ইসলামের কোন অংশকে গ্রহণ করলে এর থেকে ফায়দা হাসিল করা সম্ভব নয়। তাই ইসলামকে ব্যক্তি জীবন এবং সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
আল্লাহর নির্দেশে:


بايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَةً

“হে ঈমানদার! তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে দাখিল হও।”


নিজের খেয়াল-খুশি ও সুবিধামতো ইসলামের কতগুলো বিধানকে গ্রহণ করে বাকিটুকুন বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে চললে গোমরাহী থেকে মুক্ত হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা আল্লাহর শাস্তি ও লাঞ্ছনার কারণও।


ذلِك افَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاء مَنْ يَفْعَلُ : مِنْكُمُ الأَحْرَى فِي الْحَرةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدَّ الْعَذَابِ

“তোমরা কি কুরআনের একাংশকে মানো, আর অপর অংশকে মানো না? যারা এরকম করবে তাদের জন্য এ ছাড়া বিনিময় আর কি হতে পারে যে, তাদেরকে দুনিয়াতে অপমানিত করা হবে আর আখেরাতে কঠিনতম আযাবের দিকে ঠেলে নেয়া হবে।” (সূরা বাকারা: ৮৫)


আমাদের সমাজে আজ এ ধারণা অত্যন্ত সুদৃঢ় ও বদ্ধমূল যে, ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে পালন করলেই চলে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অপরাপর কর্মকাণ্ডে ইসলামকে অনুসরণের প্রয়োজন নেই বা ইসলাম একটা পুরনো ধর্ম হিসেবে আধুনিক যুগ সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম নয়। অথচ ইসলাম এক কালজয়ী মতাদর্শ।
আল্লাহর বাণী:


واتممتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَالْمَمْتُ 

“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদা : ৩)


নিজের খেয়াল-খুশিমতো চলা, প্রবৃত্তির অনুসরণ করা এক চূড়ান্ত গোমরাহী।


 وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هُوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ

“তার চাইতে অধিকতর গোমরাহ আর কে হতে পারে যে আল্লাহর হেদায়াত বাদ দিয়ে নিজ প্রবৃত্তির ইচ্ছেমতো চলে?” (সূরা কাসাস : ৫০)


যত অকল্যাণ, বিপর্যয় ও ধ্বংস আজ মানব সভ্যতাকে গ্রাস করতে চলেছে-এর মূলে রয়েছে প্রবৃত্তির ইচ্ছা চরিতার্থ করার অদম্য লিন্সা। যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির দাস, তার দ্বারা কোন ‘শুভ’ আশা করা যায় না। অনেক সময় অবচেতনভাবেও এ অন্ধগলিতে কেউ কেউ চলে যেতে পারেন। তাই এর পরিণাম সম্পর্কে মানুষকে সজাগ ও সচেতন করে তুলতে হবে এবং প্রকৃত সফলতার জন্য ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা এবং তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা তুলে ধরতে হবে।


নিম্নের আয়াতে উদাহরণ তুলে ধরে এ ব্যাপারে দায়িত্ব সচেতন হবার ইঙ্গিত করা হয়েছে।


وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ التَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ

“নগরীর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি দ্রুত ছুটে আসলো, বললো- হে আমার জাতি! তোমরা এই রাসূলদের অনুসরণ করো।” (সূরা ইয়াসীন: ২০-২১)


সকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও একজন মুমিনকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটাই কুরআনের বিধান। ছাত্র মজলিসের দাওয়াতী কাজের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণ তথা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের অনুভূতি জাগ্রত করা।

দ্বিতীয় দফা কর্মসূচি: সংগঠন
যেসব ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে অংশ নিতে আগ্রহী তাদেরকে এই সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা সংঘবদ্ধতা মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম যেমন নিছক ব্যক্তিগত ধর্মমাত্র নয়, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে পরিপূর্ণ মুসলমান থাকাও যায় না।
হযরত উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে তা পরিস্ফুট হয়েছে:


لَا إِسْلَامَ إِلَّا بِالْجَمَاعَةِ وَلَا جَمَاعَةَ إِلَّا بِالْإِمَارَةِ وَلَا إِمَارَةَ بِالطَّاعَةِ

“সংগঠন ছাড়া ইসলাম (পূর্ণ পালন করা) হয় না। নেতৃত্ববিহীন সংগঠন চলে না এবং আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব (সফল) হয় না।”


কারণ আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান, সমাজে ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ও উচ্ছেদের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্যই মুসলমানদের প্রেরণ করা হয়েছে:


كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ

“তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা তাই মানুষকে সৎকাজের আদেশ কর এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখ।” (সূরা আলে-ইমরান: ১১০)


বলাবাহুল্য, এ কাজ একাকী কারো পক্ষে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। কোন সমাজে যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকে না, তখন সমাজের অধিকাংশ মানুষই নিজের খেয়াল-খুশিমতো জীবন যাপন করে। পরিণামে ফেতনা-ফাসাদ ও অশান্তিতে সমাজ হয়ে পড়ে পরিপূর্ণ। উপরোক্ত আয়াতে তাই ঈমানদারদেরকে বলা হয়েছে- মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরা ও অন্যায়কে প্রতিরোধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের জন্য সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির পথকে নিশ্চিত করতে। সংঘবদ্ধ শক্তি বা সুশৃঙ্খল সংগঠন ছাড়া তা অসম্ভব।
কুরআনের অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ


قَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلَّهُ لِللَّهِ

“তোমরা সংগ্রাম অব্যাহত রাখো যতক্ষণ না সমাজ থেকে ফিতনা-ফাসাদ মূলোৎপাটিত হয় এবং সার্বিকভাবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।”


আয়াতে ‘কাতিলু’ অর্থাৎ ‘লড়াই কর’ শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘হুম’ শব্দ দ্বারা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টিকারী ইসলাম বিরোধী শক্তিকে বুঝানো হয়েছে। এ শব্দটিও বহুবচন। সুতরাং সম্মিলিত ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী শক্তিকেও সুসংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিচ্ছিন্নতা বা বিক্ষিপ্ততা একত্রে বড় প্রতিবন্ধক। তাই আল্লাহর নির্দেশ:


واعتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

“তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে (আল-কুরআনকে) আঁকড়ে ধরো বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৩)


দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান মূলত একটা দল বা একটা সংগঠন। আল-কুরআনে তাদেরকে ‘হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর দলরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে:


إن هذه اكُمُ اللهُ وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونَ

“এবং মূলত তোমরা একই দলভুক্ত আর আমি তোমাদের প্রভু, সুতরাং তোমরা একমাত্র আমাকেই ভয় করো।” (সূরা মুমিনুন: ৫২)


আবু দাউদ শরীফে উদ্ধৃত নিম্নের হাদীসখানা এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য।


عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ ثَلْثَةٍ فِي قَرْيَةِ وَلَا بُدَّ وَلَا تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلوةُ إِلَّا قَدْ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذَّابُ الْقَاصِيَةَ

“হযরত আবু দারদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোন জঙ্গল কিংবা জনপদে তিনজন লোকও যদি বসবাস করে এবং সেখানে তারা যদি (জামাতবদ্ধভাবে) নামায আদায়ের ব্যবস্থা না করে তবে তাদের উপর শয়তান অবশ্যই আধিপত্য বিস্তার করবে। অতএব জামাতবদ্ধ হয়ে থাকা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য। কেননা পাল থেকে বিচ্ছিন্ন ছাগলকে নেকড়ে বাঘ সহজেই খেয়ে ফেলে।”


কেউ যদি মনে করে, জামাতবদ্ধ বা সংগঠিত হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই, তাহলে তার জন্য উপরোক্ত দৃষ্টান্ত যথেষ্ট। সুতরাং শয়তানের আক্রমণ থেকে
নিজের ঈমান ও আমলকে হেফাযত করতে হলে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে। নতুবা-


مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قَيْدَ شِيرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِيقَةَ الْإِسْلَامِ عَنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يُرَاجِعُ

“যে ব্যক্তি সংগঠন থেকে এক বিঘত পরিমাণ বাইরে চলে গেল, সে ইসলামের রজ্জুকে তার গলদেশ থেকে খুলে ফেললো, যতক্ষণ না সে পুনরায় এসে যোগ দেবে।”

 (হযরত হারেসুল আশআরী থেকে বর্ণিত, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী)
আল্লাহর বাণী:


 ولتكن منكم الله يدعونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ، وَيَنْهَونَ عَنِ

“তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকতেই হবে যারা মানবজাতিকে কল্যাণের পথে ডাকবে। সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করবে। আর এরাই হবে সফলকাম।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৪)


তাই সকল প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংকোচ ও হীনমন্যতা পরিহার করে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে নিবেদিত সংগঠনে দাখিল হওয়া কর্তব্য। এ সত্য অনুভূত ও উপলব্ধি হবার পর কোনরূপ সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ নেই।


ولا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

“তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত হয়ে রয়েছে এবং সত্য সুস্পষ্ট হয়ে আসার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জন্য খুব বড় ধরনের আযাবের ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৫)


তাই সমাজ থেকে ফিতনা-ফাসাদের মূলোচ্ছেদ, অন্যায়-অনাচার, জুলুম-নিষ্পেষণ এবং সকল প্রকার দুর্নীতির প্রতিরোধে (তানহাওনা আনিল মুনকার) ন্যায়নীতির চির কল্যাণময় আদর্শ ‘ইসলামের’ প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি নিজের ঈমান ও আমলের হেফাযত এবং পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে জীবন যাপনের জন্য সংগঠিত দ্বীনী জীবন অপরিহার্য। কুরআন মজীদের অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সংঘবদ্ধ থাকার জন্য মুমিনদেরকে বলা হয়েছে।


তাই ইসলামকে এক পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে নিজের ব্যক্তি জীবন এবং সমাজে বাস্তবায়ন করতে যারা এগিয়ে আসবেন, তাদের জন্য দলবদ্ধ বা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন। আল-কুরআন ও হাদীসের এ নির্দেশের আলোকেই ছাত্র মজলিসের দ্বিতীয় দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তাই সাধারণ অর্থে ‘পার্টি’ করার স্বার্থে ছাত্র মজলিসের পতাকাতলে সমবেত হওয়া নয়, অপর কাউকে এ দৃষ্টিভঙ্গিতে সংঘবদ্ধ করা নয়, বরং এর মাধ্যমে অর্পিত দ্বীনী যিম্মাদারী আঞ্জাম দিয়ে অপরকেও এ পথে আহ্বান জানায়।

 

তৃতীয় দফা কর্মসূচি: প্রশিক্ষণ
এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান, সে অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের যোগ্য কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।


কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু সংগঠন গড়ে তোলাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন ঐ আদর্শের আলোকে সংগঠিত কর্মীবাহিনীর নৈতিক ও আদর্শিক প্রশিক্ষণ, চারিত্রিক মজবুতী এবং চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার আমূল পরিশুদ্ধি। নতুবা এর অভাবে সংগঠন একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী, হঠকারী গ্রপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তাদের পরিচালিত আন্দোলন হয়ে ওঠে ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যারা করবেন তাদেরকে শুধুমাত্র গালভরা বুলি আওড়ালে চলবে না। কাম্য মানের কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন জ্ঞানগত, চারিত্রিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ ও পরিশুদ্ধি- ‘তাযকিয়াহ’। একজন কর্মীর সামগ্রিক ‘তাযকিয়াহ’ এর মাধ্যমে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের যোগ্য সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের তৃতীয় দফা কর্মসূচি।


আল-কুরআনের ঘোষণা:

قد افلح من تركي

“প্রকৃত সফলকাম তারাই যারা নিজেকে তাযকিয়াহ (পরিশুদ্ধ) করলো।” (সূরা আ’লা: ১৩)


প্রকৃত ‘তাযকিয়াহ’-এর জন্য একনিষ্ঠ ঈমান এবং আমলে সালিহা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলেন:


وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ

“আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যারা একনিষ্ঠ ঈমানদার এবং আমলে সালিহা’র অধিকারী পৃথিবীতে অবশ্যই তাদেরকে খেলাফত রাষ্ট্রক্ষমতা দান করবেন।” (সূরা নূর: ৫৫)


তৃতীয় দফা কর্মসূচির প্রধান দিকগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল।
    

সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত সংঘবদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান প্রদান
ইসলাম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ‘তাওয়াক্কুল’ হ্রাস পায়। তাই সর্বপ্রথম ইসলামী জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রশিক্ষণ বা তাযকিয়া পর্বের প্রথম কাজ ইসলামী জ্ঞান প্রদান-দ্বীনী ইলম শিক্ষাদান।


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

“তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে কুরআনের জ্ঞান নিজে শিখে এবং অপরকে শিখায়।” (আল-হাদীস)


আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য-


لَقَدْ مَنَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنْفُسِهِمْ يَشْلُوا عليهم أيتهم ويُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ

“প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাদেরই মধ্য থেকে রাসূল পাঠিয়ে মুমিনদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করলেন, যিনি তাদেরকে খোদার আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা দেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৬৪)


كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُوا عَلَيْكُمْ ابْتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَالَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ

“যেমন আমি তোমাদের প্রতি তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছি যাতে তিনি তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনান, তোমাদের চারিত্রিক পরিশুদ্ধি করেন, আমার কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং সে সব বিষয়ে তোমাদেরকে তালিম-প্রশিক্ষণ দেন, যা তোমাদের অজ্ঞাত।” (সূরা বাকারা: ১৫১)


অপর আয়াতে বলা হয়েছে:


وَلَكِنْ كَانُوا رَبَّانِينَ بِمَا كُنهُم تُعلَمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُونَ

“তিনি (নবী) তো এটা বলবেন যে, তোমরা আল্লাহওয়ালা হও, যেমন কিতাবও (আল-কুরআন) এর তাগিদ দিচ্ছে যা তোমরা নিজেরা শিখ এবং অন্যকেও তার প্রশিক্ষণ দাও।” (সূরা আলে-ইমরান: ৭৯)


এছাড়া আল-কুরআনের বাকারা ১২৯, জুমুআ ২, আলে-ইমরান ৪৮, কাহাফ ৬৬, লুকমান ১২, মুজাদিলা ১১, তালাক ১১ প্রভৃতি আয়াত ছাড়াও অসংখ্য জায়গায় কুরআনের তথা ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে।


হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ


تعلمو الْفَرَائِضَ وَالْقُرْآنَ وَعَلِمُوا النَّاسَ

“তোমরা কুরআন ও অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান শিক্ষা কর এবং তা মানুষকে শেখাও।” (তিরমিযী)


তাই ছাত্র মজলিসের প্রশিক্ষণের প্রথম কাজ হচ্ছে ইসলামী সমাজ কায়েমের এই কাফেলায় যারা শরীক হবেন তাদেরকে দ্বীনী জ্ঞান দানের ব্যবস্থা করা। কর্মশালা, প্রশিক্ষণ চক্র, কুরআন ক্লাস, সামষ্টিক অধ্যয়ন, শিক্ষাসভা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান প্রদানের ব্যবস্থা করা এ দফার অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য কাজ।


    আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি
বক্তব্য বিষয়ের প্রতিফলন নিজেদের চরিত্রের মধ্যে থাকতে হবে। নতুবা তা হবে প্রতারণার শামিল।
আল্লাহ বলেন:


انتَ مُرُونَ النَّاسَ بِالْبَيرِ وَتَنْسَسُونَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَبَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

“তোমরা মানুষকে ভাল কাজের নির্দেশ দিচ্ছো কিন্তু এ ব্যাপারে নিজেদেরকে একেবারেই ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন করছো। তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক কি মোটেই কাজে লাগে না?” (সূরা বাকারা: ৪৪)


কথা ও কাজের এ বৈপরীত্যকে আল্লাহ মোটেই সহ্য করেন না।

 كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ

“আল্লাহর কাছে তা বড়ই ক্রোধের বিষয় যে, তোমরা যা বল সে অনুসারে কাজ কর না।” (সূরা সফ: ৩)


ছাত্র মজলিস তার কর্মী বাহিনীর মধ্যে আদর্শ চরিত্র সৃষ্টির ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

بُعِثْتُ لِانْتِمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ

“আমি প্রেরিত হয়েছি নৈতিক চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্য।” (মুয়াত্তা মালেক)


আল-কুরআন অধ্যয়ন করলে জানা যায়, ঈমানের পর পরই ‘আমলে সালিহা’র কথা বলা হয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতে সার্বিক সফলতা অর্জনের জন্যও সৎ চরিত্র অপরিহার্য। এজন্য কুরআন ও হাদীসে ‘মারূফ’ কাজ করা ও ‘মুনকার, ফাহেশা, লাগউ’ (বেহুদা কাজ), শিরক থেকে বেঁচে থাকার কথা বলা হয়েছে।


ছাত্র মজলিসের কর্মসূচি, কর্মী গঠন প্রক্রিয়া, নেতৃত্ব নির্ধারণ এবং সংগঠনের সার্বিক পরিবেশ ও মেজাজ এভাবেই তৈরি যে একজনের পক্ষে ‘মারুফ’-এর গুণাবলী অর্জন ছাড়া অন্য কোন যোগ্যতার প্রাধান্য দিয়ে এখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তেমনি ‘মুনকার’ পথে চলাও তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। যেমন ছাত্র মজলিসের কর্মী, সহযোগী সদস্য ও সদস্য হতে হলে যে সমস্ত আইনগত ও নিয়মতান্ত্রিক বিধান পালন করতে হয়, এতে ঈমান, তাকওয়া, ইসলামী জ্ঞান, আমানতদারী, নিজ জীবনে ত্যাগ ও কুরবানীর বাস্তব প্রতিফলন, সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দ্বীনে হকের প্রতিষ্ঠাকে নিজ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করা প্রভৃতি যোগ্যতার বিকাশ তার ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত না হলে অসংখ্য বৈষয়িক যোগ্যতা থাকার পরও ছাত্র মজলিসের সাংগঠনিক পরিবেশে সে সবের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মুত্তাকী মুসলিমরূপে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। তাই আমাদের কোন ভাই যখন এই কাফেলার সদস্য হবার শপথ গ্রহণ করেন তাকে আল-কুরআনের সেই আয়াতটুকু উচ্চারণ করতে হয়, যা আল্লাহর রঙে রঙিন একজন মুমিনের অকুণ্ঠ উচ্চারণ হিসেবে বিধৃত:

إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ

“নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার সুকৃতি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই মহান আল্লাহর জন্য, যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক।”


সুতরাং ছাত্র মজলিসের কর্মীকে প্রতিনিয়ত এই আহ্বানের আলোকেই নিজেকে অগ্রসর করার ব্যক্তিগত, সামষ্টিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়।
ঠিক এর বিপরীতে কোন ন্যূনতম মুনকার কাজেও কারো আগ্রহান্বিত করার পরিবেশ এখানেও নেই। যেমনটি সিগারেট-পান, পরীক্ষায় নকল করা প্রমাণিত হলে ছাত্র মজলিসের সদস্য হিসেবে তার পরিচয় দেবার অধিকার থাকবে না। এছাড়া এর চেয়ে নিম্নস্তরের বিষয়গুলোর ব্যাপারে সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এই সাধারণ বিষয়গুলোর আলোকে সহজেই বিচার করা যেতে পারে।


তাছাড়া পারস্পরিক ‘মুহাসাবা’র মাধ্যমে মানবীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণের এক অনুপম সাংগঠনিক পরিবেশ একজন কর্মীকে তার চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। ছাত্র মজলিসের প্রতিটি সভায় সর্বশেষ কর্মসূচি হচ্ছে ‘ইহতেসাব’-গঠনমূলক পারস্পরিক সমালোচনা। এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) সেই বাণীকে সামনে রাখা হয়-

 الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ مِرأَة

“এক মুমিন অন্য মুমিনের আয়নাস্বরূপ।”


মোটকথা একটা সামগ্রিক পরিবেশ যখন ব্যক্তির সৎ গুণাবলী বিকাশের সহায়ক হয়, তখন তার পক্ষে অন্যায় পথে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।


    মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধন
ইসলামী বিপ্লবের সফলতার জন্য মৌলিক মানবীয় যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে একজন কর্মীকে। কারণ ইসলাম সমাজবিচ্ছিন্ন বা লোকালয় থেকে পৃথক থাকার কোন শিক্ষা দেয় না। ইসলাম মানুষের জন্য এবং তা মানব সমাজেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য পরিবেশ জ্ঞান, পরিস্থিতি বিশ্লেষণের যোগ্যতা, যথাযথ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমসাময়িক সমস্যাবলী ও সমাধানের প্রক্রিয়া অনুধাবন, বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র ও কূটচাল চিহ্নিত করতে পারা, আমাদের সমাজ জীবন, ব্যক্তি ও মননে জাহেলিয়াত কিভাবে অনুপ্রবেশ করেছে তার সম্যক উপলব্ধি হচ্ছে মৌলিক মানবীয় যোগ্যতার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া প্রেম, ভালবাসা, ধৈর্য, সহনশীলতা, উদারতা, অন্যের হক আদায় করা, ইয়াতীম-মিসকীন ও গরীবকে দান করা, রোগীর সেবা-যত্ন প্রভৃতিও প্রয়োজন। এসব সম্পর্কে গাফেল থেকে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ যদি শুধু আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করেন তবে এতে দুনিয়া ও আখেরাতে কোথাও কোন কল্যাণ নেই।


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

 لَا رُهْبَانِيَّةَ فِي الْإِسْلَامِ

“ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই।”


আল্লাহ তার প্রত্যেক নবীকে সম-সাময়িক কালের সর্বোচ্চ যোগ্যতা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ‘কালো পাথর’ নিয়ে বিরোধ-মীমাংসা, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়সহ বিভিন্ন যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও তদানীন্তন জনগণের উপর তাঁর যে অপরিসীম প্রভাব ছিল তা প্রতিফলিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রথম দাওয়াতের জন্য তাঁর ‘কওম’কে পাহাড়ের পাদদেশে আহ্বান করেছিলেন, তখন সমাজের সর্বশ্রেণীর লোক সেখানে সমবেত হয়েছিল। সুউন্নত ও আস্থাশীল চরিত্র না থাকলে এমনটি হতো না। ইসলামী আন্দোলনের যেকোন কর্মীকে অনুরূপ মানবীয় যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব ও মননশীলতার অধিকারী হতে হবে।


ছাত্র মজলিস মৌলিক মানবীয় যোগ্যতার বিকাশ ও ব্যক্তির অন্তঃসুপ্ত ইতিবাচক গুণাবলীর উন্নয়ন সাধনের জন্যই এই কর্মসূচিকে তৃতীয় দফা কর্মসূচির অন্যতম কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।


    ইসলামী সমাজ বিপ্লবের যোগ্য কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ
আল্লাহর পথে চলতে গেলে জাহেলিয়াতের সাথে দ্বন্দু অনিবার্য। ইসলামের বিপরীত যা, সবই জাহেলিয়াত বা কুফরী।


الْإِسْلامُ نُورة الكُفْرُ ظلمة

“ইসলাম হচ্ছে জ্যোর্তিময় আর কুফর হলো অন্ধকার।”


কুফর সব সময় যুলমাত ও জাহেলিয়াত-অন্ধকার এবং মূর্খতার মধ্যে মানুষকে নিমজ্জিত করে রাখতে চায়। তাই ইসলামের শাশ্বত আলোর উদ্ভাসকে সে নিভিয়ে দিতে তৎপর-


يريدُونَ لِطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَالله يم نور

“তারা চায় আল্লাহর ‘নূর’কে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রাখবেন।” (সূরা সফ: ৮)


কুরআনের অপর আয়াতে বলা হয়েছে:


اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أوليائهم الطاعون يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ

“মুমিনের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন এবং কাফেরদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে ‘তাগুত’, সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে প্রবিষ্ট করায়।” (সূরা বাকারা: ২৫৭)


ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো চলা এবং জাগতিক লিন্সা চরিতার্থ করতে পারবে না বলেই কুফরী শক্তি ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ক্ষেত্র বিশেষে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মানুষকে দ্বীনের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে চায় এবং নানান অপকৌশলের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের পথে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।


ক. আদর্শিক চ্যালেঞ্জ: জাহেলিয়াতের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম চ্যালেঞ্জ আসে আদর্শের উপর। ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে যাতে জনতার মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে এর থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় সেজন্য বিভিন্ন কাল্পনিক অভিযোগ সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়।


قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا أَمَنَ السُّفَهَا :

“তারা বলে আমরা কি নির্বোধদের মতো ঈমান আনতে পারি?” (সূরা বাকারা: ১৩)


ইসলামকে তারা সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রগতির বিরোধী আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। তাই তারা বলে-

 إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ

“আমরাইতো প্রকৃত সংস্কারবাদী, প্রগতিশীল।” (সূরা বাকারা: ১১) অপর আয়াতে আছে:


قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ أَبَانَنَا

“তারা বলল, তুমি কি এজন্য এসেছ যে আমাদেরকে সে পথ-পন্থা থেকে ফিরিয়ে নেবে যার উপর আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি?” (সূরা ইউনুস: ৭৮)
এ সমস্ত তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জের অসারতা প্রমাণ করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছিলেন এ উদ্দেশ্যে:


لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُله

“যাতে তিনি সব বাতিল মতবাদের (চ্যালেঞ্জের) উপর ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেন।” (সূরা সফ: ৯)


খ. প্রতিরোধ ও ভীতি প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ: ইসলাম বিরোধী শক্তি আদর্শিকভাবে ইসলামী আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে না পারলে সত্যিকার অর্থে পারার কথাও নয়- তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনকে প্রতিরোধ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও নির্যাতনের মাধ্যমে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করতে চাইবে-

 وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللَّهِ يَدْعُوهُ كَادُوا يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًا

“এবং আল্লাহর বান্দা যখন তাকে ডাকার জন্যে উঠে দাঁড়ালো তখনই তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুত হলো।” (সূরা জীন: ১৯)


ইসলাম বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি আসবে, শারীরিক নির্যাতন, জেল-জুলুম ও অবরোধের সম্মুখীন করে বস্তুত এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি করা হবে।


مَتَهُمُ الْبَنْسَاءُ وَالقَرَاء وَالزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ ملى نصر الله

“তাদের উপর বহু কষ্ট, কঠোরতা ও কঠিন বিপদ-মুসিবত আবর্তিত হয়েছে। তাদেরকে অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত করে দেয়া হয়েছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তদানীন্তন রাসূল ও সঙ্গী-সাথীগণ আর্তনাদ করে উঠেছে (ও বলেছে) আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?” (সূরা বাকারা: ২১৪)


তাই জাহেলিয়াতের এই চর্তুমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।


أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ

“তারা কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর।”


وَكَانَ مِنْ نَّبِي قَتَلَ مَعَهُ رَونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعَفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا

“এমন অনেক নবী ছিলেন যাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা লোক লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে লড়াই করতে গিয়ে তাদের সামনে যত বাধা-মুসিবত এসেছে তাতে তারা মনভাঙা হয়নি, কোন প্রকার দুর্বলতা প্রদর্শন করেনি এমনকি বাতিলের সামনে মাথা নত করেনি।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৪৬)


ইসলামী ছাত্র মজলিসের সামগ্রিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, চারিত্রিক পরিশুদ্ধি এবং বাতিলের মোকাবেলায় অটল-অবিচল আল্লাহর সৈনিকরূপে গড়ে তোলা।


চতুর্থ দফা কর্মসূচি: আন্দোলন
ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, ছাত্র সমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন এবং শোষণ, জুলুম, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে জনমত গঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো।


একটা সমাজের মূল ভিত ও ভবিষ্যত রচিত হয় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। শিক্ষাব্যবস্থাকে অনৈসলামী রেখে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষতা ও বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত। এর দ্বারা একদল প্রবৃত্তিপূজারী, পাশ্চাত্যানুকরণের অন্ধ দাস ছাড়া আর কিছুই তৈরি হচ্ছে না। তাই এই শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।


اقْرَأْ بِسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

“পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক: ১)


স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞান ছাড়া কোন জ্ঞানই পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত নয়- সবই গোমরাহী। আর এ গোমরাহী একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত সত্যের বিপরীতে এনে দাঁড় করায়। ফলে যে শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলা, তা আর হয়ে ওঠে না। প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসবে।


الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمُ

“তিনি সেই আল্লাহ যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।” (সূরা আলাক ৪-৫)


অপর আয়াতে বলা হয়েছে-


افَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّمَا انْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَى

“তা কী করে সম্ভব? যে ব্যক্তি তোমার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবকে সত্য বলে মানে, আর যে এ ব্যাপারে অন্ধ দু’জনই সমান হয়ে যাবে? (সূরা রাআদ: ১৯)


স্রষ্টার জ্ঞানের ব্যাপারে যারা অজ্ঞ, বাহ্যিক অবয়বে ইন্দ্রিয় অনুভূতিসম্পন্ন জীব হলেও প্রকৃত অর্থে তারা ইন্দ্রিয়তাড়িত পশুর মতই থেকে যায়।
আল্লাহ বলেন-  

 
لَهُمْ قُلُوبٌ لا يَفْقَهُونَ بِهَا

“তাদের অন্তঃকরণ আছে কিন্তু তারা প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে না।”


কাজেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত না করলে বাঞ্ছিত ফল আশা করা যায় না। এ শিক্ষা হতে হবে আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির উপযোগী ও সার্বজনীন। শিক্ষার দুয়ার থাকবে সবার জন্য অবারিত। কাউকে অশিক্ষার অন্ধকারে রাখা যাবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্খতা কুফরের শামিল। কারণ সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণু, দিন-রাত্রির আবর্তন, আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি পরতে পরতে মহান আল্লাহর নিদর্শন বিরাজমান, যা একজন মূর্খ ব্যক্তির পক্ষে উপলব্ধি করা অসম্ভব। আল্লাহর ঘোষণা:

 قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتِ وَالنُّورِ

“বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হতে পারে, আলো আর অন্ধকার কি কখনো এক হয়?” (সূরা রাআদ: ১৬)


إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَايَتِ لِأُولِي الْأَلْبَابِ

“নিঃসন্দেহে আকাশ-পৃথিবীর সৃষ্টি, রাত্র-দিনের আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।


তাই ইসলামের শিক্ষা হবে সার্বজনীন ও গণমুখী। আল-কুরআনের আহ্বান হচ্ছে সার্বজনীন ও সবার জন্য। পবিত্র কুরআনে সর্বপ্রথম ‘হে মানব সকল’ (বাকারা: ২১) বলে সম্বোধন করা হয়েছে।


ইসলামী ছাত্র মজলিসের অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে সমাজ থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করার জন্য আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির উপযোগী একটা গণমুখী ও সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করা।


মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। অথচ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মানুষের অধিকারকে খর্ব করে তাদেরকে দাস বানিয়ে রাখতে চায়। নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা আশ্রয় নেয় শোষণ, নিপীড়ন, জুলুম ও নির্যাতনের। মানুষ এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। আল্লাহ বলেন:


وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا

“তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ নির্যাতিত নারী-পুরুষ ও দুর্বল শিশুরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই জালেমদের জনপদ থেকে উদ্ধার কর।” (সূরা নিসা: ৭৫)


নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে মানবতার সার্বিক মুক্তির জন্যে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় সমাজ অন্যায়-অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও ফাসাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কুরআনের নির্দেশ-


قَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَتَكُونَ الدِّينُ لهُ اللَّهِ

“তোমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাও, যতক্ষণ পর্যন্ত না পৃথিবী থেকে ফিতনা-ফাসাদের মূলোৎপাটিত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।” (সূরা আনফাল : ৩৯)


প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য এই যে, সে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে।


الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ

“যারা ঈমানদার তারা খোদার পথে লড়াই করে, আর যারা কুফরীর পথ গ্রহণ করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে।” (সূরা নিসা: ৭৬)


আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে হবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেন: 


شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بة إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

“তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যার হুকুম তিনি নুহকে দিয়েছিলেন। আর যা অহীর সাহায্যে এখন তোমার নিকট পাঠিয়েছি। যার বিধান আমি ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকেও দিয়েছিলাম এই তাগিদ সহকারে যে, দ্বীন কায়েম কর এবং এতে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা শুরা: ১০)


تَعَالَوْا إِلى كَلِمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ اللَّهُ كَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا مُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

“এসো, এমন এক কালিমার দিকে যা তোমাদের এবং আমাদের মাঝে সমান। আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবো না, তার সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া একে অপরকে প্রভু স্বীকার করব না।” (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪)


আল্লাহর পথে সংগ্রাম বা জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহ-এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম নিছক শুভাকাঙ্ক্ষা বা দোয়ার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বাতিল যেখানে ইসলামকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর সম্মিলিত ও চূড়ান্ত সংগ্রাম ছাড়া ইসলাম করা সেখানে অসম্ভব। তাই আল-কুরআন ও হাদীসে জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।


এ পথে কেউ যদি শাহাদত বরণ করে তার জন্য যেমন রয়েছে অনন্ত পুরস্কার, তেমনি এ দায়িত্ব পালন থেকে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত পিছপা হয় তাহলে তার জন্য রয়েছে কঠিনতম আযাব। ঈমানের পরপরই জিহাদের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে। তাই মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করে পৃথিবী থেকে শোষণ, জুলুম এবং নির্যাতনের অবসানে আল্লাহ দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক সংগ্রাম চালানো প্রতিটি মুমিনের জন্য অপরিহার্য। ছাত্র মজলিসের চূড়ান্ত কর্মসূচি হচ্ছে দ্বীন কায়েম করা। ছাত্র মজলিস চায় শোষণ-জুলুমের অবসান ঘটুক। মানবতা মুক্তি পাক। দাওয়াত, তানজীম ও তারবিয়াতের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এই জিহাদের জন্য যোগ্য সৈনিক তৈরি করাই আমাদের কাজ।


দুনিয়াবি কোন লাভালাভ বা স্বার্থচিন্তা এ পথে আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগায়নি। এর মাধ্যমে মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনই ছাত্র মজলিসের উদ্দেশ্য। ছাত্র মজলিসের কর্মসূচি মনগড়া কল্পনাপ্রসূত চিন্তার কোন ফসল নয়। আল-কুরআন ও হাদীস থেকে এর উৎস গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি ছাত্র মজলিসের প্রতিটি কর্মকৌশলও ইসলামী নীতিমালার আলোকে প্রণীত।


ইসলামী ছাত্র মজলিস এক স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান


মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাই মানব চরিত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী এক আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কি সে দায়িত্ব প্রতিপালনে যথাযথভাবেই সক্ষম? এ বিষয়টির মূল্যায়নের আগে আমাদেরকে সর্বাগ্রে আরেকটি বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন, তা হলো- শিক্ষার প্রয়োজন কেন?

 মানব চরিত্রের দুটো দিক
যে সকল মৌলিক উপাদান দিয়ে মানুষের দেহকাঠামো তৈরি- তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাসমূহ লক্ষ্য করলে এর প্রধান দুটো দিক আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একটি হচ্ছে এর পাশবিক সত্তা আরেকটি হচ্ছে মানবিক সত্তা। একদিকে লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, কাম-ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতার মত নোংরা স্বভাব। অন্যদিকে ভালবাসা, দয়া, ধৈর্য, সহনশীলতা ও সৃজনশীল স্বভাব। প্রথম স্বভাবের বিচারে মানুষ এবং পশুতে কোন তফাৎ নেই, যদি না সে মানবিক গুণাবলীতে ভূষিত হয়ে যাবতীয় পশুত্বকে পরাভূত করতে পারে। বলাবাহুল্য, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই মানবীয় মূল্যবোধেরই বিকাশ।


 মূল্যবোধের মাপকাঠি
মূল্যবোধের এ মাপকাঠি দিয়েই বিচার করতে হবে একটি শিক্ষাব্যবস্থা কতখানি মানোত্তীর্ণ অথবা ব্যর্থ। দিন দিন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না প্রকৃত মানবীয় চরিত্রসম্পন্ন লোকের সংখ্যা। সর্বত্রই আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষিত একজন লোকের কাছে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয় সুরুচি, ভদ্রতা, শোভন ও শালীন আচরণ; আশা করা হয় নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা; দেশ, সমাজ ও জাতিসত্তার প্রতি দায়িত্ববোধ; লোভ, মোহবর্জিত ও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সৃজনশীল আচরণ; ধৈর্য ও সহনশীলতায় পুষ্ট দৃঢ়চেতা ও আত্মপ্রত্যয়ী চরিত্র। আশা করা হয় না উচ্ছৃঙ্খল ও নোংরামী জীবনধারার প্রতি তার আকর্ষণ, শুধুমাত্র বাহ্যিক ভোগ-বিলাস, যশ-প্রতিপত্তি ও অবাঞ্ছিত খ্যাতিলাভের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, হাওয়ার তালে নেচে গেয়ে আগামীকাল বাঁচতে না পারার আশঙ্কায় জীবনটাকে যাচ্ছেতাই এখনই উপভোগ করার বিকৃত জৈবিক মানসিকতা, এক দুরন্ত যাযাবরের মতো লক্ষ্যহীন পথচলা।


আমাদের সমাজ দেহের সর্বত্র আজ লক্ষ্যহীন পথচলার দুষ্টক্ষত। শিক্ষা মানুষকে তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের দিক-নির্দেশনা প্রদান করবে. এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে যেরূপ দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতারই জ্বলন্ত উদাহরণ। “বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে”, সুতরাং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যে আমাদের যুব, তারুণ্য ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ ও অনুপযোগী তা আর অধিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে না।


গোলামি মানসিকতা ও শিক্ষার ব্যবস্থা
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই বৃটিশ শাসনামলের গোলামি যুগে তৈরি। স্বাভাবিকভাবেই তারা চায়নি এর দ্বারা সত্যিকার স্বাধীনচেতা, সৃজনশীল ও নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত জাতিসত্তা গড়ে উঠুক। এর মধ্যে যতটুকু ইতিবাচক ‘পয়েন্ট’ পাওয়া যায় তা ছিল নিছক তাদের মুখরক্ষার ব্যানার মাত্র। অনেকে এর থেকে এগিয়ে আর ভাবতে পারেন না কিছুই। ধরে নেন আমাদের জন্য এটুকুনই যথেষ্ট। ভাঙ্গা ইংরেজি বুলি শিখে কখনো তাদের সাথে সাযুজ্য রেখে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন। ভাবেন- ঢের হয়েছে। চলনে-বলনে, চিন্তায় ও আচরণে ‘কাকের ময়ুর নাচা’র অবস্থা! নিজের আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে অন্যের অসংলগ্ন অনুকরণের ব্যর্থ প্রয়াস।


দৃষ্টি যেখানে পরাণুকরণের বৃত্তে সীমাবদ্ধ সেখানে বৃত্ত ডিঙানোর প্রশ্ন অবান্তর। একেই বলে গোলামি মানসিকতা। এককালে এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া গেছে; শহরে পড়ুয়া শিক্ষিত ছেলের কাছে গ্রামের আনকালচারড্ (!) চাষা বাবা আসলে ছেলে তার সতীর্থদের বলতো, আমাদের বাড়ির কাজের লোক- ঙঁৎ ড়নবফরবহঃ ংবৎাধহঃ। সে সচেতনভাবে ভুলে যেতো তার উৎসমূল। ঠিক তেমনি এ শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রজন্মকে ভুলাতে বসেছে আমাদের প্রকৃত আত্মপরিচয়, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, আদর্শিক মূল্যবোধের অনুশীলন ও সত্যিকার গন্তব্যের ঠিকানা।

    
জেনে নিতে হবে
তাই আমাদেরকে জেনে নিতে হবে আমাদের প্রকৃত পরিচয় কী? কোন আদর্শে রয়েছে আমাদের জীবন চলার পূর্ণ পথ নির্দেশিকা, আমাদের সত্যিকার গন্তব্য কোথায়। সর্বোপরি এর পাথেয় সংগ্রহে আমাদের করণীয় কী? সামনে নিশ্চিত কদম ফেলতে হলে এসবের প্রকৃত সন্ধান জানা প্রয়োজন। বিভ্রান্ত-বিহ্বল যুব তারুণ্যকে দিতে হবে সঠিক পথের দিশা। আমাদের শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে জীবন গড়ার যথার্থ মূল্যবোধ, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি। আন্তরিক পরিচর্যা ও পরিতোষণের মাধ্যমে তাদের মেধা ও মননশীলতাকে রক্ষা করতে হবে সকল বিকৃতি ও অবক্ষয়ের হাত থেকে। কিন্তু যুগের কালস্রোত যেদিকে ধাবমান তাকে উপেক্ষা করে বিপরীতে কোন স্রোতধারার কথা কি আদৌ কল্পনা করা যায়? যারা


সত্যান্বেষী, যারা চান মানুষগুলো মানুষ হোক, আমাদের এ সমাজ, এ গ্রহ সুন্দর সুখময় ও প্রকৃত অর্থেই বাসোপযোগী হোক, তাদের কাছে এটা এক বিরাট প্রশ্ন।


 এক বলিষ্ঠ উচ্চারণ
ইসলামী ছাত্র মজলিস প্রবহমান স্রোতের বিপরীতে এক বলিষ্ঠ উচ্চারণ। আমাদের প্রজন্মকে আগামী দিনের বিপ্লবের নায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে এক গঠনমূলক অনন্য কর্মসূচি নিয়ে ছাত্র মজলিস এগিয়ে এসেছে লক্ষ প্রাণের বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে। প্রচলিত গতানুগতিক পদ্ধতিতে যারা সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের জন্যও ছাত্র মজলিস এক স্বতন্ত্র উদাহরণ। চিরাচরিত ছাঁচের বাইরে এক ব্যতিক্রমী শ্লোগান নিয়ে ছাত্র মজলিসের যাত্রা শুরু। জ্বালাও, পোড়াও ধরনের কোন আপাতঃ উত্তেজক ঘোষণা কিংবা অস্ত্রের মোকাবেলায় অস্ত্রধারণ, শক্তির মোকাবেলায় শক্তি প্রয়োগের অবিনাশী ধারণায় ছাত্র মজলিস বিশ্বাসী নয়। জ্ঞান ও চরিত্রের বিকাশ এবং এ দু’য়ের মিলিত শক্তিকে পৃথিবীর তাবৎ জঞ্জালকে প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে ছাত্র মজলিস বিশ্বাস করে। কে না জানে জ্ঞান চর্চার অভাব এবং চারিত্রিক অধঃপতনই আমাদেরকে আজ ক্রান্তিলগ্নে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই অসীম শূন্যতা পূরণ করতে না পারলে নিশ্চিত ধ্বংস ছাড়া আমাদের জন্য পথ আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারি যাত্রাকালীন সময়েই ছাত্র মজলিস আহ্বান জানিয়েছে “জ্ঞান অর্জন, চরিত্রগঠন ও সমাজ বিপ্লবের জিহাদে শরীক হোন।”


একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ছাত্র মজলিস এক স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অবারিত জ্ঞান চর্চা, মননশীলতার বিকাশ, অনুপম চারিত্রিক মজবুতী অর্জন ও সর্বোপরি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার এক বিকল্প শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ছাত্র মজলিস সমস্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। সমাজের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্য অবস্থানের মুখে ছাত্র মজলিস এক নিশ্চিত গন্তব্যের পথ নির্দেশক আলোকবর্তিকা। সকল প্রকার কুসংস্কার ও জাহেলিয়াতের প্রভাবমুক্ত হয়ে ঈমানের নূরে অভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধি অর্জন, সমাজের অজস্র মনোলোভা হাতছানির মুখে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ এবং সমাজ বিপ্লবের জিহাদে আত্মসচেতন ও আত্মত্যাগী লোক তৈরি করার জিহাদই ছাত্র মজলিসের ব্রত। তাই দ্বীনী এ কাফেলায় যারা শরীক হন তারা একাধারে নিজের প্রতি যেমন উদাসীন থাকতে পারেন না তেমনি তার দেশ, সমাজ এবং জাতিসত্তার প্রতিও কর্তব্যের সমান তাগিদ অনুভব করেন। ভেতরে-বাইরে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন তিনি।


নানান বিরুদ্ধ প্রচারণার জাল ছিন্ন করে, মজলিসের এ নিভাঁজ কণ্ঠকে চাপা দেবার অপচেষ্টা ডিঙিয়ে ছাত্র মজলিসের এ স্বাতন্ত্র্যই অনন্য বৈশিষ্ট্যে ধরা দিয়েছে সাধারণ ছাত্র সমাজের কাছে।


 জ্ঞান অর্জন
ইসলামী ছাত্র মজলিস জ্ঞানার্জনের প্রতি জোর দিয়েছে সর্বাগ্রে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সার্টিফিকেট বিতরণ করছে ঠিকই, কিন্তু সমাজ মানস থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে পারছে কতটুকু? নানান কুসংস্কার এবং আন্দাজ-অনুমাননির্ভর জীবন যাপন প্রকৃত হেদায়াতের সন্ধান না পাওয়ারই প্রতিশ্রুতি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতগুলো সুনির্ধারিত প্রশ্নের তৈরি নোট মুখস্থ করিয়েই কর্তব্য সম্পাদন করছে এখন পর্যন্ত। ছাত্র মজলিস এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করছে। আমরা কারা, আমরা কোথেকে আসলাম, এখানে কী আমাদের করণীয়, কোন পথ অবলম্বন করে আমরা চলবো, আমাদের শেষ পরিণতি কী, নিজের ছাড়া সমাজের অন্য মানুষের প্রতি আমাদের কোন দায়িত্ব আছে কী, থাকলে তা কতটুকু- এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অথচ একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের জন্য এসব প্রশ্নের জবাব জানা জরুরি।

 

 আদর্শ নির্ধারণ
ছাত্র মজলিস সর্বপ্রথম তুলে ধরে জীবনের আদর্শের সুষ্ঠু পরিচয়। কারণ, আদর্শ জানা না থাকার কারণেই নিজের খেয়ালখুশি অথবা আন্দাজ-অনুমাননির্ভর পথে ‘দেখি না কি হয়’ ভাবে চলছে, বিশেষত আমাদের যুব সমাজ। ছাত্র মজলিস একজন ছাত্রের কাছে সর্বপ্রথম তুলে ধরা ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্যের আদর্শ। আর জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব আছে একমাত্র ইসলামের মধ্যেই। অন্যান্য প্রচলিত মতাদর্শগুলো ‘বর্তমান’কে নিয়ে নানান সূত্র দাঁড় করালেও এর পূর্বে আমরা কোথায় ছিলাম, কোথেকে আসলাম অথবা এর পরের প্রশ্ন-আমাদের শেষ পরিণতি কী, শেষ গন্তব্য কোথায়? এসব প্রশ্নের ব্যাপারে কোন কথাই বলতে পারছে না।


ইসলাম সুষ্ঠুভাবে বলে দিচ্ছে, আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা, আমরা তাঁর কাছ থেকেই এসেছি, মৃত্যুর পর রয়েছে এক অনন্ত জীবন। সেখানে আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি কাজকর্মের হিসেব প্রদান করতে হবে। ভাল কাজের জন্য রয়েছে পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য রয়েছে কঠিনতর শাস্তি। এ কথা দ্বারা এটাও পরিষ্কার হলো যে, এ পৃথিবীতে মানুষ এক দায়িত্বশীল প্রাণী। তাই একমাত্র ইসলামই সর্বাধুনিক ও পরিপূর্ণ জীবন বিধান। দ্বিধা, সংশয় এবং অনিশ্চিত জীবন যাপনের হতাশাপূর্ণ অন্ধকূপ থেকে মুক্তিকল্পে ছাত্র মজলিস সর্বপ্রথমেই একজন ছাত্রের সামনে উপস্থাপন করছে তার জীবনের আদর্শ কী হওয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক পড়াশুনা, জ্ঞান চর্চা ও অনুশীলনের। ছাত্র মজলিস কোনরূপ গলাবাজিতে বিশ্বাসী নয়।


প্রকৃত অর্থেই সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রতিটি শাখা-উপশাখায় এর অনুপম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের গৃহীত চার দফা কর্মসূচির করণীয় দিকগুলো সম্পর্কে চিন্তা করলে যে কাউকে তা আকর্ষণ করতে বাধ্য। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, ইসলামী সাহিত্য পাঠ ও বিতরণ, পাঠচক্র, স্টাডিক্লাস, সামষ্টিক অধ্যয়ন, আলোচনা সভা, প্রতিযোগিতা, বিতর্ক অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে শুধু জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থাই করা হয়নি বরং কর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনশক্তির জন্য উপযোগী সিলেবাস তৈরি করে এর অনুসরণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

 

 ভাল ছাত্র হওয়া
ছাত্র মজলিসের কর্মীদেরকে ভাল ছাত্র হিসেবে গড়ার জন্যও সংগঠন সব সময়ই সচেষ্ট।


ইসলামী আন্দোলনকে ভালভাবে বুঝতে হলে ভাল ছাত্র হওয়া চাই। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে না পারলেও স্কুল, কলেজ, মাদরাসা- যারা যে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সে ক্ষেত্রে উত্তম রেজাল্টের অধিকারী হতে হবে। সংগঠন তাই পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্বকে অধিক হারে তুলে ধরার জন্য প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান ও তদারকের এক সাংগঠনিক ঝুংঃবস চালু করেছে। এছাড়া তা ব্যক্তিগত রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে প্রতিটি সাপ্তাহিক বৈঠকে তাকে সামষ্টিকভাবে জবাবদিহিতারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এভাবেই ছাত্র মজলিসের একজন কর্মীর পড়াশুনার মান ধীরে ধীরে উন্নত হয়। সুতরাং এই সংগঠনে এসে অহেতুক কারো ছাত্রত্ব হারাবার আশংকা নেই। মাদরাসা ছাত্রদেরকে বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার প্রতি ছাত্র মজলিস গুরুত্ব দিয়ে থাকে।


মেধা ও মননশীলতার বিকাশ
শুধু আক্ষরিক জ্ঞান দানই যথেষ্ট নয়। একজন ছাত্রের সুপ্ত মেধা ও প্রতিভা বিকাশের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। যার যে বিষয়ে আগ্রহ আছে তাকে সে বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন ও বিকাশে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিক হারে দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে তৎসংশ্লিষ্ট কাজে তাকে উৎসাহিত করা এবং সর্বপ্রকার লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও অহংকারের অবদমন করে এর উপর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, সত্যিকার সৃজনশীল মানসিকতা সৃষ্টির পরিসরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এসব বিষয়ের তত্ত্বাবধান ছাড়াও জ্ঞানগত সমৃদ্ধি, আত্মার উন্নয়ন ও চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে এক অনুপম পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।


 চরিত্র গঠন
চারিত্রিক অধঃপতন আজ সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। মিথ্যা, প্রতারণা, জালিয়াতি, সুদ, ঘুষ প্রভৃতি এখন জাতীয় চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সর্বত্রই আজ চরিত্রবান লোকের অভাব। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকগণ শুধু আক্ষরিক জ্ঞানদান করেন, কিন্তু কোন চারিত্রিক আদর্শ উপস্থাপন করেন না। রেডিও, টেলিভিশন, নাটক, সিনেমার প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো যুব তরুণদের চরিত্র হনন। ভিডিও ক্লাবের দৌরাত্ম্য আজ ঘরে ঘরে। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার মানসিকতায় সমাজের এক শ্রেণীর দুষ্টলোক যুবকদের হাতে তুলে দিচ্ছে অতি দামী হেরোইন ও নেশাজাত দ্রব্য। রাষ্ট্রের উপর তলার লোকেরাও এর সাথে জড়িত থাকার কথা আজ সুবিদিত। বাবা-মা-অভিভাবকগণও এক্ষেত্রে অসহায়। এর থেকে জন্ম নিচ্ছে আরও নানান চরিত্র হননকারী উপসর্গসমূহের। অবস্থাদৃষ্টে সবাই আতঙ্কিত। কারো যেনো করার কিছু নেই। সমাজকর্তারা যেখানে ব্যর্থ, শিক্ষকগণ যেখানে অপারগ ও অভিভাবকগণ যেখানে অসহায় সেখানে ছাত্র মজলিস এগিয়ে এসেছে আশার আলোকবর্তিকা নিয়ে, আদর্শ চরিত্রবান নাগরিক গড়ে তোলার সুস্পষ্ট কর্মসূচি নিয়ে।


 ব্যক্তিগত চরিত্র
শুধু অন্যকে কর্তব্য সচেতনতার কথা বলেই ছাত্র মজলিসের কর্মীরা দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করে না। বরং তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করা হয়েছে যে, প্রতিটি কাজের সর্বপ্রথম দাবি হচ্ছে নিজের ব্যক্তিগত চরিত্রে এর উদাহরণ সৃষ্টি করা। গোটা সাংগঠনিক পরিবেশটাই এভাবে তৈরী যে, কাজ না করে কাউকে শুধু নির্দেশ প্রদান করা অত্যন্ত লজ্জাকর এবং অবমাননাকর বিষয়। তাই পারতপক্ষে কারো পক্ষে এ রকম আচরণ অসম্ভব। “কাজ নেই, কাম নেই, কিল মারার গোঁসাই” আমাদের গোটা সমাজ মানসে এই দুষ্ট প্রবণতা জেঁকে বসেছে। ছাত্র মজলিসের প্রতিটি কর্মীকে গড়ে তোলা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভঙ্গি নিয়ে। এছাড়া একদম শুরু থেকেই একজন ছাত্র মজলিস কর্মীকে এগিয়ে আসতে হয় এক সুনির্দিষ্ট ও সুশৃঙ্খল রুটিন গধরহঃধরহ করে।

ব্যক্তিগত পরিকল্পনা
প্রত্যেককে বছরের শুরুতে বার্ষিক এবং এটাকে সামনে রেখে মাসের শুরুতে মাসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। সাপ্তাহিক এবং মাসিক বৈঠকে তার পর্যালোচনা ও রিপোর্টিং অনুষ্ঠিত হয়। ফলে তার পক্ষে অপরিকল্পিত সময় ব্যয় অথবা অবসর কাটানো, অহেতুক ফালতু কোন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়া সত্যিই কষ্টসাধ্য। অঙ্কুরেই একজন ছাত্র মজলিসের কর্মী তাই পরিকল্পিত জীবন গঠনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আর এ কারণেই তারা অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র ও আকর্ষণের পাত্র।

 

 ব্যক্তিগত রিপোর্ট
ইসলাম ছাত্র মজলিসের প্রতিটি কর্মীকেই ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখতে হয়। অধ্যয়ন, পড়াশুনা ও অন্যান্য কাজের যথাযথ প্রতিবেদন সংরক্ষিত হয় এ রিপোর্টে। ফলে নিজের সামগ্রিক অবস্থার একটা সংক্ষিপ্ত জীবন চিত্র প্রতিফলিত হয় এতে। সমাজের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব পালনে যারা এগিয়ে এসেছেন তারা বেহিসেবী জীবন যাপন করবেন কেন? আল্লাহর কাছে নিজের সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে একবার। তাই এ জীবনেও আমাদের হিসেব করে চলা উচিত। হাদীসের এ মর্মবাণী একজন ছাত্র মজলিস কর্মীকে উজ্জীবিত করে- “খোদার কাছে হিসেব দেয়ার আগে নিজেই নিজের হিসেব নাও।” এভাবেই একজন ছাত্র মজলিস কর্মীর চরিত্র দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে। তারা এ সমাজের অধিবাসী হয়েও গড়ে ওঠে সত্যিকার মুত্তাকী ও আল্লাহর বান্দা হিসেবে।


আমাদের সমাজে আজ আমরা সহজেই দেখতে পাচ্ছি পিতা-মাতা পর্যন্ত তার সন্তানদের যথাযথ খোঁজখবর রাখতে পারছে না। এমনি এক অবস্থায় ছাত্র মজলিস একজন বিকল্প অভিভাবকের ভূমিকাও পালন করছে। তাইতো দেখেছি অনেক অভিভাবক ছুটে আসেন তার সন্তানকে সাথে করে আমাদের অফিসে। বক্তব্য একটাই, তিনি ছাত্র মজলিসের এই সুন্দর পরিচর্যার পরিবেশে তার সন্তানকে তুলে দিয়ে আশ্বস্ত হতে চান।


 আত্মবিচার
ছাত্র মজলিস তার কর্মীদেরকে শিক্ষা দেয় আত্মবিচারমূলক জীবন গঠনের। কারণ, নিজের বিচার নিজে করতে না পারলে অন্যের বিচার করা যায় না। যারা সমাজে ইনসাফ কায়েমের সংগ্রামে অবতীর্ণ তাদেরকে তাই অভ্যস্ত হতে হয় আত্মবিচারমূলক জীবন গঠনের।


সমাজের মানুষ যদি নিজ বিবেকের কাছে দায়ী হতো, তাহলে এত অশান্তি, এত উচ্ছৃঙ্খলতা আজ আমাদেরকে গ্রাস করতো না। ছাত্র মজলিসের কর্মীরা প্রকৃত অর্থেই বিবেকবান হিসেবে গড়ে ওঠে। অন্যায়ের সুযোগ যত অবাধই হোক স্বাভাবিক বিবেক তাড়নার প্রশিক্ষণই তাকে প্রতিরোধ করবে। আর প্রকৃত দায়িত্ববান তো তারাই, যারা কোন আইনের কাছে নয়, দায়ী থাকে নিজ বিবেকের কাছে। আমরা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শ্রেণী ডিঙানোর যতটুকু তালীম পাচ্ছি ঠিক ততখানি পাচ্ছি না ন্যায়ের মূল্যবোধ ও বিবেকের শিক্ষা। ছাত্র মজলিস একদল বিবেকবান লোক তৈরির কারখানাও বটে।


ছাত্র মজলিসের গোটা সাংগঠনিক পরিবেশ এমনভাবে তৈরি যে, এখানে কারো পক্ষে অন্যায় পথে চলা সম্ভব নয়। কখনও কারো মধ্যে যদি নিতান্তই কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাহলে ‘এহতেসাব’-এর মাধ্যমে একজন কর্মী অন্য কর্মীকে তুলে ধরেন সে বিষয়টা- একজন প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষীর মতো। যেমনটি হাদীসে বলা হয়েছে, “একজন মুমিন অন্য মুমিনের আয়নাস্বরূপ”। আয়না যেমন কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য ছাড়াই দ্রষ্টার কাছে তুলে ধরে তার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ঠিক তেমনি। ফলে এ কাফেলার প্রতিটি নেতা-কর্মী গড়ে ওঠে এক পরিপূর্ণ মমতায় পরিপূর্ণ হয়ে।


দ্বীনী জীবন যাপন
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির জীবনী শক্তি ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু মুখরক্ষার শেষ দীপটুকু জ্বেলে রাখছে তারা এখন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিয়ে। তাদের গানের কথায় নতুন কোন আবেদন নেই বলে উৎকট মিউজিকের তালে মাতিয়ে রাখতে চাইছে এ প্রজন্মকে। বলাবাহুল্য, এর মরণথাবা গ্রাস করতে চলেছে আমাদের যুব তরুণদের জীবনকে। ইসলামই একমাত্র উপস্থাপন করেছে সত্যিকার জীবনের আদর্শ ও সংস্কৃতি। ইসলামের সংস্কৃতি হলো আল্লাহ, রাসূল, আখেরাতে বিশ্বাস ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ পথে যারা নিজের জীবনকে গড়ে তোলেন তাদেরকেই বলা হয় প্রকৃত ‘মুত্তাকী’।


ছাত্র মজলিসের কর্মীবাহিনী সমাজের এ বৈরী পরিবেশে সদা-সর্বদা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে দ্বীনী জীবন যাপনের শিক্ষায়। মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনই যেখানে সবকিছু। এজন্যই তাকে কোনরূপ বাহ্যিক চাকচিক্য মূল লক্ষ্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। নিয়মিত কুরআন-হাদীসের শিক্ষা, ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন, একাগ্রচিত্তে নামায আদায় ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়সহ তাদের প্রতিটি কাজই সম্পাদিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে। দ্বীনী জীবন যাপনের এ অনুপম পরিবেশ যে কোন ঈমানদারেরই কাঙ্ক্ষিত। তাইতো ছাত্র মজলিসের একজন সদস্যকেও তাঁর শপথনামায় উচ্চারণ করতে হয়, ‘আমার নামায, আমার সুকৃতি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই মহান আল্লাহর জন্য’ নিবেদিত। নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শে হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে ছাত্র মজলিস গড়ে উঠেছে একটি দ্বীনী কাফেলায়।

 

জাতীয় ও সামাজিক দায়িত্ব
মানুষ সাধারণভাবে আজ জাতীয় ও সামাজিক কর্তব্য ভুলতে বসেছে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই অবনী পরে। দেশ ও সমাজের প্রতি সমান দায়িত্ববোধ জাগ্রত করেই ছাত্র মজলিস তার কর্মীদেরকে গড়ে তোলে “প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”-এ শিক্ষায়। প্রতিটি কর্মশালায় অন্যতম শ্লোগান “অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দাও”, ইসলামের শিক্ষাও তাই। মিতব্যয়িতা, আমানতদারী, ওয়াদা পালন, সময় ও নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুবর্তী হওয়া এ কাফেলার প্রতিটি কর্মসূচির অঙ্গ। পরীক্ষায় নকল প্রবণতা রোধে আজ যেখানে শিক্ষক, গুণীজনসহ প্রশাসন পর্যন্ত গলদঘর্ম সেখানে এ কাফেলার সহযোগীরা নকল করবে তা কল্পনাও করতে পারে না। ধুমপান প্রতিরোধে কোটি টাকা খরচ করে চলছে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা, কিন্তু আল্লাহর রহমতে ছাত্র মজলিসের প্রতিটি মেস, কার্যালয় ধূমপানের কালিমা থেকে মুক্ত। এর জন্য প্রয়োজন হয়নি পৃথক কোন আইনের। সংগঠনের বিরাজিত পরিবেশ, সামষ্টিক শিক্ষাই এসব প্রবণতার বিরোধী।


এমনিভাবে একটা নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য নিটোল চরিত্রের অধিকারী একদল মুর্দে মুমিন তৈরী করে ছাত্র মজলিস জাতীয় এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে প্রতিটি কর্মীকে গড়ে তুলেছে একজন পরিপূর্ণ মানুষরূপে- সকল প্রকার পশুত্বকে পরাভূত করে মানবিক ও দ্বীনী যোগ্যতায় পরিপূর্ণ করে। এ সমাজের আধুনিক শিক্ষায়তনগুলো যা করছে না- এ দায়িত্ব পালন করছে ছাত্র মজলিস, একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে, নিষ্ঠার সাথে।


ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতা ও ইসলামী ছাত্র মজলিস
বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়শই একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- এত দল ও সংগঠনের ভিড়ে আরেকটা সংগঠনের আবির্ভাব খুব কি অপরিহার্য ছিল? যেকোন সুজন, সুবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের মনে এ রকম প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ চুন খেয়ে কারো মুখ যদি পুড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে চাকবাঁধা দধি দেখেও তার তনুমন আঁতকে ওঠার কথা। ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করে জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন ও সমাজ বিপ্লবের জিহাদে শরীক হবার আহ্বান জানিয়ে ইসলামী ছাত্র মজলিস আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির বর্তমান ঝোঁক প্রবণতা ও জীবন বিনাশী নিষ্ঠুর জিঘাংসার উন্মত্ত রূপ দেখে ছাত্র মজলিসের এই আবির্ভাবকেও অনেকে একই সমতলে নতুন সংযোজন বলে ভাবতে পারেন।


কিন্তু তিমির আঁধারের মধ্যেও যেমন থাকে ভোরের সোনালী সূর্যালোকের দীপ্তভাব, পাহাড়ের কঠিন শিলা ভেদ করেও যেমন বেরিয়ে আসে জীবন জাগানিয়া নিটোল ঝর্ণাধারা। ইসলামী ছাত্র মজলিসের আবির্ভাবও তেমনি। সন্ত্রাস-হানাহানি, খুন-ভায়োলেন্স এবং অস্থির অশান্ত ভাঙ্গনোন্মুখ ছাত্র রাজনীতির এই ‘চুনপোড়া’ আতঙ্কই ইঙ্গিত দেয় এখানে অতি অবশ্যই প্রয়োজন দেশ-জাতি ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত, আদর্শ ও কর্মসূচির সজীবতায় উজ্জীবিত একটি গঠনমূলক আপোসহীন ধারার ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র মজলিস এ ঐতিহাসিক অনিবার্যতারই ফলশ্রুতি মাত্র। বিষয়টি একটু বিশ্লেষণের দাবি রাখে।


ভাঙছে সমাজ
সৃষ্টিলোকের প্রতিটি জিনিসই পরস্পরের পরিপূরক- একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের অধীন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে মানুষ ততই তার নেতৃত্বের আসন থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করেছে। ইহ-জাগতিকতা, বস্তুবাদিতা, অতি ভোগবাদী মনোভাব মানুষের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে স্বার্থপরতার অভিশাপ। ফলে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে মানুষের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে হতাশা, অস্থিরতা। অক্টোপাশের বেষ্টনী থেকে যেমন বের হয়ে আসা অসম্ভব, তেমনি হতাশ ব্যক্তিমানস হারিয়ে ফেলে তার জীবনের প্রকৃত ঠিকানা। সামনে যা কিছু পায়- পরম নির্ভরতার সাথে তারই আশ্রয়ে সে আপন অস্তিত্ব ধরে রাখতে চায়। এ মোক্ষম সুযোগটিই আমাদের এই স্বপ্নসাধের বাংলাদেশের অতি সাফল্যজনকভাবে সুখ-স্বাদের আহাদ বাণী শুনিয়ে মন-মানসিকতা, পরিবার-শিক্ষা-সংস্কৃতি সর্বত্র শুরু করেছে নব্য দাসত্বের অবিরাম চাষাবাদ। বলাবাহুল্য এক্ষেত্রে তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রজন্মের সাহসী তারুণ্য ছাত্র সমাজ।


 অস্থির শিক্ষাঙ্গন: অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত
শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে মানুষ তৈরীর কারখানা। একটা জাতির ভিত-ভবিষ্যৎ তৈরি হয় এখানেই। অথচ আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোই আজ বড় বেশি অশান্ত। লেখাপড়ার পরিবেশ নেই, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নেই, লাইব্রেরী-পাঠাগার, সেমিনার কক্ষে ছাত্রদের উপস্থিতি অতি দ্রুত নেমে আসছে শূন্য ডিগ্রীতে। নেই জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, ভাল হবার সাধনা- ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটিই বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের এখন সাধারণ চিত্র। এ চিত্র বর্ণনার চেয়েও বাড়ন্ত, অনুমানের চেয়েও ভয়াবহ। সন্ত্রাস ও মাস্তানীর তালিম গ্রহণ, খুনের মহড়ায় হাত পাকানো, খুনী-সন্ত্রাসী-ফেরারদের আড্ডা ও পুনর্বাসনের নিরাপদ সদর্প চলাচলের কুম্ভ হয়ে উঠেছে শিক্ষাঙ্গনের ক্যাম্পাস বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। কোন সাধারণ নাগরিক নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে পারতপক্ষে ঐ এলাকায় আর যেতে চান না। সাধারণ বিদ্যার্থী এবং ছাত্রসমাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা এখন আর নিরাপদ বিবেচিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিচলিত হয়ে কবি আল মাহমুদের সখেদ উচ্চারণ-’বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকাতদের গ্রাম’।


এ থেকে বুঝতে কারো কষ্ট হবার কথা নয় শিক্ষাঙ্গন পরিস্থিতি আজ কোন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মূল্যবোধ, দেশ, ধর্ম ও জাতীয় চেতনায়। এভাবেই সমূলে উৎপাটিত হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিশাল সৌধটি। ফলে সার্টিফিকেটধারী লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু বাড়ছে না প্রকৃত দেশপ্রেমিক, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, কর্তব্যনিষ্ঠ প্রজন্ম। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত।


 ভাবনার বিষয়
শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড, আর সংস্কৃতি হচ্ছে এর প্রাণ। প্রকৃত সুশিক্ষা গ্রহণ ও চরিত্র অর্জন করে ছাত্র সমাজই পারে একটা জাতিকে গৌরবের আসনে বসাতে। আজকের ছাত্র সমাজ কি জাতির সে আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারছে? শিক্ষাক্ষেত্রে দেউলিয়াত্ব এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের নোংরা জোয়ারের অবগাহনে ছাত্র সমাজ আজ দিশেহারা, দিকভ্রান্ত।


পরিবর্তন জরুরি
এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। দেশ, জাতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজকে রাহুর এ করালগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে। হতাশা উদ্ভ্রান্ত, উত্তেজিত ছাত্র সমাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে পরিশীলিত নাগরিকতাবোধ। হাতে তুলে দিতে হবে অস্ত্রের বদলে কলম, মাস্তানী ও সন্ত্রাসের বদলে সৃষ্টি করতে হবে জ্ঞানান্বেষণের অদম্য স্পৃহা। ছিনতাই, পরস্বাপহরণের পরিবর্তে সৃষ্টি করতে হবে আপন পায়ে দাঁড়াবার সাহসী হিম্মত।


ছাত্র নেতৃত্ব ও ছাত্র আন্দোলন
এক্ষেত্রে গঠনমূলক ছাত্র আন্দোলন ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিকট অতীতের ইতিহাস অন্তত একথাই বলে। ছাত্ররা যেহেতু সমাজের সবচাইতে সচেতন ও আপোসহীন নাগরিক। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে বিকশিত হতে থাকে দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণ চিন্তা। ভাল কিছু করা, ভাল কিছু পাওয়ার এক ইচ্ছা অবিরাম উথলে উঠে তাদের হৃদয়-মনকে করে তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সহজাত বিদ্রোহী। তাই ছাত্র রাজনীতির আহ্বান তাদের মনে স্বাভাবিকভাবে দোলা দেয়। তাদেরকে আকৃষ্ট ও উদ্দীপিত করে। ছাত্ররা তাদের বয়স, মানসিকতা এবং আবেগের কারণেই স্বাধীনচেতা। তাই আরোপিত কোন নিয়ম-বাঁধন, কোন শৃঙ্খল তারা মানতে চায় না। এক্ষেত্রে দক্ষ, যোগ্য ও চরিত্রবান ছাত্রনেতৃত্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আরবি সাহিত্যে একটা প্রবাদ আছে, “প্রত্যেক দল তার সমগোত্রীয়ের সাথে খেলা করে থাকে।” সুতরাং ছাত্রদের উপর ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্র নেতৃত্বের ভূমিকা যে সবচাইতে কার্যকর ও প্রভাবশালী এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।


 কাঙ্ক্ষিত ধারা
কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত আন্দোলনের বাহন সংগঠন ও এর নেতৃত্ব কেমন হবে- এ প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ছাত্র যত ভালই হোক- অবশ্যই তার মধ্যে সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের প্রভাব পড়তে বাধ্য। সংগঠন ও নেতৃত্ব যদি কাম্য মানের না হয়, তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। এজন্য সংগঠন ও নেতৃত্বের মধ্যে কিছু কাম্য বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থাকা অবশ্যই জরুরি।


 সংগঠন
নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর অভাবে একটা সংগঠন যেমন দিনে দিনে সন্ত্রাস-ভায়োলেন্স ও চাঁদাবাজির সংগঠনে পরিণত হবে, তেমনি সংশ্লিষ্ট ছাত্রের জীবনেও নেমে আসবে অমানিশা।


১. আদর্শের ব্যাপারে কোনরূপ জোড়াতালি অথবা কৌশলের স্বার্থে এর অনুশীলন আপাত মূলতবি অথবা জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না।


২. সুস্পষ্ট কর্মসূচি: শুধুমাত্র প্রশাসন কিংবা সরকার বিরোধিতা, গরম-শীতের মতই কিছু মৌসুমী মিছিল, মিটিং, দেয়াল লিখন, বিবৃতি এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও পরাজিত করার কৌশল চর্চার মাধ্যমে যথার্থ দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে না।


৩. মূল্যবোধের প্রাধান্য ও বিকাশ এবং সকল ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ পন্থা অবলম্বন।


৪. কর্মীদের আদর্শিক ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। অন্যায় ও সীমালংঘনমূলক কাজে যথাযথ সাংগঠনিক শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা।

৫. নিয়মতান্ত্রিক পথে নেতৃত্ব নির্বাচন ও পরিবর্তনের ব্যবস্থা।


৬.  জ্ঞানার্জনের কর্মসূচি, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ।


৭. দেশপ্রেম, কল্যাণ চিন্তা ও নিজের চেয়ে মানব মুক্তির চিন্তার চর্চা ও বিকাশের কর্মপন্থা থাকা।


  নেতৃত্ব
ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা থাকবে তাদেরকে প্রকারান্তরে পালন করতে হয় সমাজ বিপ্লবের কর্মী তৈরীর দায়িত্ব। তাকেও আকর্ষণীয় চরিত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১.    চরিত্রবান হওয়া।
২.    আদর্শ ও আন্দোলনের প্রতি ঈড়সসরঃসবহঃ থাকা।
৩.    সুযোগ-সুবিধার জন্য দল ও আদর্শ পরিবর্তন করা।
৪.    ভাল ও নিয়মিত ছাত্র হওয়া।
৫.    কর্মীদের প্রতি ভালবাসা।
৬.    হঠকারী সিদ্ধান্ত ও মানসিকতাপ্রবণ না হওয়া।


এ ধরনের সংগঠন ও নেতৃত্বের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলনকেই আমরা বলবো গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক। এতে একজন ছাত্র সত্যিকার অর্থেই গড়ে উঠবে আদর্শ চরিত্রবান ও ভবিষ্যত জাতীয় নেতৃত্বের উপযোগিতা নিয়ে।

 

ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতা
কিন্তু চলমান রাজনীতির প্রবণতা দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শুধুই ভাঙন, ক্ষোভের প্রকাশ, জিঘাংসা চরিতার্থকরণ ও প্রতিপক্ষকে পরাজিতকরণই ছাত্র রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া মাস্তানী, চাঁদাবাজি, হুমকি, হয়রানি, শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা দিন দিন আসন গেড়ে বসছে। ছাত্র নেতৃত্বকে এখন কেউ ভালবাসতে পারছে কিনা সেটা খুঁজে দেখার বিষয়। তবে সবাই যে ভয়ের চোখে দেখে এটা নিঃসন্দেহে। এরকম ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে সুকুমার চেতনার চর্চা ও বিকাশ সম্ভব নয়। কোন আন্দোলনের মধ্যে যখন জ্ঞানের চর্চা, চরিত্রবান নেতৃত্ব ও জনশক্তির সংকট দেখা দেয় তখন অনিবার্যভাবেই এ আন্দোলন কর্মসূচির যৌক্তিকতা ও আদর্শিক দেউলিয়াত্বের কারণে শক্তি প্রয়োগ, সুবিধাভোগ ও মাস্তানীর দিকে ধাবিত হবে।


এমনি অবস্থার প্রেক্ষাপটে মানবতার মুক্তির জন্য খেলাফতে রাশেদার আদর্শের আলোকে একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে একদল আদর্শ চরিত্রবান নাগরিক গড়ার লক্ষ্যে ইসলামী ছাত্র মজলিস যাত্রা শুরু করে। ছাত্র মজলিস তাই তার লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ধারাবাহিকভাবে তিনটি বিষয়কে বেছে নেয়।
১. জ্ঞানার্জন, ২. চরিত্র গঠন ও ৩. সমাজ বিপ্লবের জিহাদ।

 

স্বতন্ত্র ধারা
এ লক্ষ্যমাত্রাই প্রমাণ করে ছাত্র মজলিস সাময়িক ক্ষমতাশ্রয়ী বা ক্ষমতাপ্রার্থী গতানুগতিক ছাত্র আন্দোলনের ধারায় পরিবর্তন আনতে চায়। প্রত্যেক সচেতন বিবেকবান মানুষই এ রকম একটি স্বতন্ত্র ধারার বিকাশ কামনা করেন। ছাত্র মজলিস একেই বাস্তব রূপ দিয়েছে মাত্র।

এ লক্ষ্যমাত্রা হাসিলের জন্য ছাত্র মজলিস গ্রহণ করেছে চারদফা স্থায়ী কর্মসূচি। যাতে রয়েছে জ্ঞানচর্চা, প্রতিভার বিকাশ, চরিত্রবানরূপে গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় নৈতিক ও আদর্শিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের নিমিত্তে নিজেকে যোগ্য, দক্ষ ও ঈড়সসরঃবফ রূপে গড়ে তোলার ব্যবস্থা। ছাত্র মজলিস তার প্রতিটি কর্মে অত্যন্ত সচেতনভাবে বস্তুবাদী বাছ-বিচারকে পরিহার করে চলে। কারণ তা সহজেই একজন ছাত্রের মধ্যে লোভ-মোহ-ভোগের মানসিকতা জন্ম দেয়। পাশাপাশি লোপ পেতে থাকে কর্তব্যনিষ্ঠা, সত্যান্বেষা ও আদর্শবাদিতা। যার পরিণামফল আমরা নিয়ত প্রত্যক্ষ করছি।


দাওয়াত, সংগঠন, চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা ও সমাজ বিপ্লবের চারদফা স্থায়ী কর্মসূচি নিয়ে ছাত্র মজলিস একটি গতিশীল ছাত্র আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়াসের কাজ করছে।


সুতরাং ভাল চরিত্র ও যোগ্যতার বিকাশে ছাত্র মজলিসের এই অভিযাত্রা ইতিহাসের শূন্যতা পূরণে মাইলফলকের ভূমিকা রাখবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।


বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্র মজলিস

এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই ছাত্র মজলিসের যাত্রা শুরু। ছাত্র মজলিসকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে নিছক একটা ছাত্র সংগঠন মনে হবে, কিন্তু যে দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের শপথে এ কাফেলার আত্মপ্রকাশ, এর প্রেক্ষাপট এবং তাৎপর্য ইসলামী বিপ্লবের অন্তর্নিহিত ভাবধারার মধ্যে নিহিত। যে কোন মৌলিক পরিবর্তনই ‘বিপ্লবরূপে’ আখ্যায়িত হতে পারে, কিন্তু ইসলামী বিপ্লব প্রচলিত তাগুতী সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠীর মনোচেতনার আমূল পরিবর্তন দাবি করে। তাই ইসলামী বিপ্লবের দাবিদার সংগঠনকে প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর সাথে কোনরূপ আপোস অথবা অংশগ্রহণের আপাতঃসহজ পন্থাকে পরিহার করে সকল প্রকার তাগুতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। ছাত্র মজলিস আপোসহীন ও বিদ্রোহীদের এক সংগ্রামী কাফেলা। একটা বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
গভীর পর্যবেক্ষণের সাথে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পৃথিবী আজ মানুষের বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। সভ্যতার জীবনী শক্তিও নিঃশেষ প্রায়। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র মানবতাকে সত্যিকার সুখের সন্ধান দিতে ব্যর্থ। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আধুনিক কলা-কৌশলের চরম বিকাশ ঘটলেও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেনি। পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা পশ্চিমা মানুষগুলোকে ভোগপিয়াসী স্বার্থপর পশুতে রূপান্তর করে ছেড়েছে। মদ, গাঁজা, হিরোইন, প্রাণঘাতী নেশাজাত দ্রব্যের ব্যবহার, ঘৃণ্য পতিতাবৃত্তি ও এইডস রোগের বিস্তার, এসবই পুঁজিবাদী সভ্যতার অবদান। তাছাড়া গোটা পৃথিবীকে তাদের দাস বানিয়ে রাখার পরিকল্পনায় জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অহেতুক যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে।


সমাজতন্ত্রের অবস্থা কী? এতদিনকার গালভরা বুলি এখন তাদের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে গেছে। মজলুম-মুস্তাদআফীন, সর্বহারা মানুষের মুক্তির শ্লোগানের অন্তরালে মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে। এ সুযোগে একেকজন স্বৈরাচার ‘আরব্য রজনীর’ কাহিনীর মতই তাদের ভোগ-বিলাসের কীর্তি রচনা করেছে। তাইতো বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকামী জনগণ জেগে উঠেছে স্বাধীনতার চেতনায়।


এদিকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা ক্ষমতায় বসে আছেন তাদের মধ্যে যেমন পরিপূর্ণ ইসলামী চরিত্র নেই, তেমনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ষড়যন্ত্রে মুসলিম দেশগুলো রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামরিক একনায়কতন্ত্রের ঘৃণ্য কবল থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি। ‘মুসলিম উম্মাহ’র কাঙ্ক্ষিত ঐক্যও তাই তাদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারছে না। ফলে মুসলমানদের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও মেধাকে লুণ্ঠন করছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। শৃঙ্খল ভাঙ্গার কি কোন পথ নেই?


পুঁজিবাদ ব্যর্থ হয়েছে। মৃত সমাজতন্ত্রের কফিন আজ ইতিহাসের জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। মানব রচিত বস্তুবাদী জীবন দর্শন এখন আর মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না।


আশার কথা
দিকে দিকে আজ জেগে উঠেছে মুসলমানেরা ঈমানী জযবায়। ট্যাংক বহরকেও চ্যালেঞ্জ করে তারা আজ রাস্তায় নেমে এসেছে জীবনবাজি রেখে। বসনিয়া, চেচনিয়া, ইরান, ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, কাশ্মীর, আফগান ও আজারবাইজানের ইসলামী জনতা জেগে উঠেছে সকল প্রতিকূলতার রক্তচক্ষু ডিঙ্গিয়ে। ঠিক এমনি সমগ্র দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে আজ ইসলামী পুনর্জাগরণের পদধ্বনি।
    
জাতীয় অবস্থা
বাংলাদেশের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে ইসলাম বিদ্বেষী স্বৈরাচারী সরকার। দুঃশাসনে এখানকার জনগণ নিষ্পিষ্ট, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন গোটা জাতিকে গ্রাস করতে চলেছে। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন বলতে গেলে অনুপস্থিত। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে, অথচ সমস্ত অনৈসলামী কার্যকলাপ চলছে অবাধে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থা আরও করুণ। সন্ত্রাসের পদভারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকম্পিত। পড়াশুনা আর অস্ত্রচর্চা পাশাপাশি চলতে পারে না। অথচ তাই হচ্ছে, চলছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে কোন দিকদর্শন দিতে পারছে না। যারা এর পরিবর্তনের কথা বলছেন তারাও ঘুরে ফিরে একই বৃত্তে অবস্থান করছেন।


তাগুতী সমাজ ব্যবস্থাই মূল সমস্যা
সবকিছুর মূলে রয়েছে তাগুতী এই সমাজ ব্যবস্থা। একে টিকিয়ে রেখে মানুষের সামগ্রিক মুক্তির কল্পনা করা বৃথা। তাই এ সমাজকে ভাঙ্গতে হবে- পরিপূর্ণভাবে। এর জন্য প্রয়োজন আমূল বিপ্লব। পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব ছাড়া কেবল আংশিক পরিবর্তন সমস্যার সমাধান করবে না। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় যারা বিশ্বাসী তাদের পক্ষে যে এ কঠিন দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।


তাগুতী সমাজব্যবস্থা
‘তাগুত’ শব্দের অর্থ সীমালঙ্ঘন। ব্যক্তিজীবনে মানুষ যখন সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ করে তখন সে আর মানুষ থাকে না পশুতে পরিণত হয়ে যায়। ঠিক তেমনি যে সমাজে মানুষ সীমালঙ্ঘন করে, অন্যের অধিকার খর্ব করে, সর্বোপরি আল্লাহর আইনের দ্বারা যেখানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়, এটাই তাগুতী সমাজ। স্বাভাবিকভাবে মানুষের প্রকৃত জীবনের উন্মেষ এখানে অকল্পনীয়। মানব চরিত্রের বর্বর দিকটাই এই সুযোগে দুর্নীতি, জুলুম, শোষণে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ। কুরআন বলছে, “তাগুত তাদেরকে আলোর পথ থেকে অন্ধকারে প্রবিষ্ট করায়।”


কারণ-
১.    যেখানে আল্লাহর আইন নেই, সেখানেই তাগুত বা ‘সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ’ প্রবল হয়ে ওঠে।

২.    ‘সীমালঙ্ঘন’ মানেই হচ্ছে অন্যের অধিকার খর্ব করা।

৩.    তাগুতী সমাজে দুর্নীতিপরায়ণরাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

৪.    অর্থ ও শক্তির দাপট বেড়ে যায়, ফলে মজলুম ‘মুস্তাদআফ’ মানুষেরা কোথাও আর ইনসাফ, সুবিচার পায় না।

৫.    স্বার্থবাজদের দ্বারা এ সমাজ পরিচালিত হয়। তাই আইন, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবই তারা তাদের অনুকূলে বানিয়ে নেয়।


এর বিপরীতে একমাত্র ইসলামই পারে মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির গ্যারান্টি দিতে। কিন্তু তাগুতী সমাজকে টিকিয়ে রেখে মজলুম মানুষের মুক্তি আসবে কিভাবে? সমাজ পরিবর্তন ও বিনির্মাণে একটা গঠনমূলক ছাত্র আন্দোলন কি ভূমিকা রাখতে পারে নিম্নে তা আলোচনা করবো।


পরিবর্তন কারা করবে?
এই পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে কারা? কারা এগিয়ে আসবে মানবতার জন্য কাঙ্ক্ষিত সেই বিপ্লব সাধনের অগ্নিক্ষরা শপথে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে? যারা প্রচলিত এ সমাজ কাঠামোতে বিশ্বাসী, তারা কখনো আংশিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করলেও পরিপূর্ণ সমাজ বিপ্লব তাদের লক্ষ্য নয়। ভিন্ন অর্থে একপর্যায়ে তারাও তাগুতী সমাজেরই সহযোগী হয়ে ওঠেন। তাই এ বিপ্লব একমাত্র তাদের পক্ষেই সম্ভব-
ক.    যারা একনিষ্ঠ ঈমানদার।
খ.    যারা আমলে সালিহা ও ইখলাসের চরিত্রে গুণান্বিত।
গ.    যারা আমূল পরিবর্তনে বিশ্বাসী।
ঘ.    যারা এই সমাজের সাথে আপোস করবে না।
ঙ.    যারা প্রচলিত এই ব্যবস্থা বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বদ্ধপরিকর।
চ.    যারা কোন পরাশক্তির প্রভুত্বকে স্বীকার করে না।
ছ.    যারা সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থ আত্মদানে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রস্তুত।


তাই এমন একটা সত্যান্বেষী দলের প্রয়োজন যারা মানবতার চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই অব্যাহত রাখবে। মানবতার বিজয় লাভের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়া অপরিহার্য। আল-কুরআনের ঘোষণা:
“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখ, যতক্ষণ ফিতনা-ফাসাদ এ সমাজ থেকে মূলোৎপাটিত হবে এবং আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভকরবে।” (সূরা আনফাল : ৩৯)

সূরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ নির্যাতিত মানুষ, নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও ফরিয়াদ করে বলছে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই জালিমের জনপদ থেকে উদ্ধার কর।”


বলাবাহুল্য, সমাজ ভাঙার এই সংগ্রামে সমাজের সচেতন অংশ ছাত্র সমাজের একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।


ছাত্র আন্দোলন
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজ পরিবর্তনে ছাত্ররা সব সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজ বিপ্লবের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সে দেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ। তাই যুগে যুগে আন্দোলনের সূচনা, বিকাশ এবং চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত ছাত্রদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য ও কার্যকর বিবেচিত হয়ে এসেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২, ‘৬৭-র ছাত্র আন্দোলন, ‘৭০ এর গণ-অভ্যুত্থান, ‘৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ আমাদের গোটা জাতির জন্যও সমান গৌরবের। ছাত্র সমাজের মধ্য থেকেই জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি হয়ে থাকে। আজকেও সমাজ নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দুতে যারা রয়েছেন তারা এক সময় ছাত্র আন্দোলনেরও শীর্ষে ছিলেন। যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলেন, তারা কি করে ভুলে যান পেছনের ভাস্বর ইতিহাস?


সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা
অবশ্য ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান চেহারা দেখলে যে কেউ হয়তো এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবেন। ‘৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ও ‘৮৭-এর নভেম্বরে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং ‘৯০ এ স্বৈরাচার পতনে ছাত্রদের ভূমিকা জাতি সবসময় অনুপ্রেরণার সাথে স্মরণ করবে। কিন্তু মাঝে মাঝে ছাত্র আন্দোলন কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়ে সন্ত্রাসের রূপ পরিগ্রহ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসের যে বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ হচ্ছে স্বৈরাচার ও স্বার্থবাদীদের পাতানো খেলা। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের


তাই এমন একটা সত্যান্বেষী দলের প্রয়োজন যারা মানবতার চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই অব্যাহত রাখবে। মানবতার বিজয় লাভের জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়া অপরিহার্য। আল-কুরআনের ঘোষণা:

“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখ, যতক্ষণ ফিতনা-ফাসাদ এ সমাজ থেকে মূলোৎপাটিত হবে এবং আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভকরবে।” (সূরা আনফাল : ৩৯)


সূরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ নির্যাতিত মানুষ, নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও ফরিয়াদ করে বলছে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই জালিমের জনপদ থেকে উদ্ধার কর।”


বলাবাহুল্য, সমাজ ভাঙার এই সংগ্রামে সমাজের সচেতন অংশ ছাত্র সমাজের একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।


ছাত্র আন্দোলন
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজ পরিবর্তনে ছাত্ররা সব সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজ বিপ্লবের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সে দেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ। তাই যুগে যুগে আন্দোলনের সূচনা, বিকাশ এবং চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত ছাত্রদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য ও কার্যকর বিবেচিত হয়ে এসেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২, ‘৬৭-র ছাত্র আন্দোলন, ‘৭০ এর গণ-অভ্যুত্থান, ‘৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ আমাদের গোটা জাতির জন্যও সমান গৌরবের। ছাত্র সমাজের মধ্য থেকেই জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি হয়ে থাকে। আজকেও সমাজ নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দুতে যারা রয়েছেন তারা এক সময় ছাত্র আন্দোলনেরও শীর্ষে ছিলেন। যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলেন, তারা কি করে ভুলে যান পেছনের ভাস্বর ইতিহাস?


সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা
অবশ্য ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান চেহারা দেখলে যে কেউ হয়তো এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবেন। ‘৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ও ‘৮৭-এর নভেম্বরে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং ‘৯০ এ স্বৈরাচার পতনে ছাত্রদের ভূমিকা জাতি সবসময় অনুপ্রেরণার সাথে স্মরণ করবে। কিন্তু মাঝে মাঝে ছাত্র আন্দোলন কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়ে সন্ত্রাসের রূপ পরিগ্রহ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসের যে বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ হচ্ছে স্বৈরাচার ও স্বার্থবাদীদের পাতানো খেলা। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের ইন্ধনও রয়েছে এর পেছনে সমানভাবে। তারা চায় না আমাদের জাতির মেরুদণ্ড সুগঠিত হোক।


নৈতিকতা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাব্যবস্থাই জাতির জন্য কাঙ্ক্ষিত নাগরিক তৈরী করে থাকে। অথচ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যা শেখানো হচ্ছে তা কি জাতিগঠনে ইতিবাচক ও যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে? পারার কথা নয়। কারণ এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে লক্ষ্যে প্রণীত হয়নি। শিক্ষায় নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের ব্যবস্থা না থাকলে তা কখনো একজন নাগরিককে প্রকৃত সুনাগরিকরূপে গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম ও ব্যর্থ। ফলে ছাত্রদের মাঝে যেরূপ জাতীয় ও আদর্শিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে না।


ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা
এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। গঠনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের কর্মীদের মধ্যে আদর্শের চর্চা ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে একটা স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে পারে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সরাসরি ছাত্রদের উপর যতখানি থাকে তা অপরাপর যেকোন শাখা-প্রশাখার চেয়ে বেশি কার্যকর। কিন্তু কতগুলো মৌলিক সমস্যা ছাত্র সংগঠনগুলোকে কাম্য ভূমিকা পালনে বাধাগ্রস্ত করছে।


ছাত্র সংগঠনের সমস্যা
সমস্যার উৎস অনুসন্ধান করলে নিম্নোক্ত কতগুলো প্রধান কারণ পাওয়া যায়:
১.    ছাত্র সংগঠনগুলো কোন সুস্পষ্ট আদর্শাশ্রয়ী না হওয়া।
২.    নেতৃত্বের দুর্বলতা বা কাম্য নেতৃত্বের অভাব।
৩.    কর্মী গঠনে গঠনমূলক কর্মসূচি না থাকা।
৪.    আদর্শের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ না থাকা।
৫.    নেতা-কর্মীদের নৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা।
৬.    রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বতন্ত্র কর্মসূচি নিতে না পারা।
৭.    ক্ষমতাশ্রয়ী হওয়া বা নিছক ক্ষমতার জন্য রাজনীতি।
৮.    অন্যায় কাজের সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। সংগঠনের নেতৃত্ব নির্ধারণে কর্মীদের অংশগ্রহণের উপর রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া।
৯.    কর্মীদের অন্যায় আচরণকে নিছক দলীয় কারণে প্রশ্রয় দেয়া।
১০.    লেজুড়বৃত্তি।


উপরোক্ত কারণে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র আন্দোলনের প্রতি ছাত্র সমাজ ও সাধারণের বিতৃষ্ণা বাড়ছে দিন দিন। প্রায় অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনই কম-বেশি উপরোক্ত দুর্বলতায় দুষ্ট। তাই স্বাভাবিকভাবেই জাতি গঠন ও সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠন, আরও ব্যাপক অর্থে ছাত্র আন্দোলনের যে ভূমিকা থাকা দরকার তা আর হয়ে উঠে না।


গঠনমূলক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা
গঠনমূলক, ইতিবাচক কর্মসূচিভিত্তিক ছাত্র আন্দোলন এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে ছাত্রদের সামনে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলতে ব্যর্থ, সেক্ষেত্রে একমাত্র গঠনমূলক, আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনই সে দায়িত্ব নিতে পারে।

 

আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠন
পরিসংখ্যানগত দিক থেকে আমাদের দেশে ছাত্র সংগঠনের কোন অভাব নেই। যতগুলো রাজনৈতিক দল, প্রায় ততটা ছাত্র সংগঠন তো রয়েছেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আদর্শের জন্য লড়াই করছে ক’টা সংগঠন। হিসেব নিলে দেখা যাবে পূর্বালোচিত সমস্যা বা দুর্বলতা প্রায় প্রতিটি সংগঠনেই বিদ্যমান। যার ফলে কর্মী বাহিনীর নৈতিক এবং আদর্শিক প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের কোন ব্যবস্থা ঐসব সংগঠনে সাধারণত পাওয়া যায় না। ফলে ‘সমাজ বদলের’ শ্লোগানে তারা রাজপথে যতটা উচ্চকিত থাকেন, ব্যক্তিজীবন এবং সাংগঠনিক পরিবেশে এর চর্চা ততটাই থাকে অনুপস্থিত। জাতি, সমাজ ও আদর্শের প্রতি যাদের কমিটমেন্ট (ঈঙগগওঞগঊঘঞ) থাকে না তাদের আন্দোলন দ্বারা তারুণ্য শক্তির যেমন অপচয় অবধারিত, তেমনি স্বৈরাচার, সুবিধাবাদী এবং কোটারী শ্রেণীর স্বার্থই সংরক্ষিত হয় এতে বেশি। ফলে এ জাতীয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত কর্মীবাহিনী নিজেদের মেধা, শ্রম এবং আত্মত্যাগ (উঅউওঈঅঞওঙঘ) দিয়েও আশাব্যঞ্জক স্তরে উন্নীত হতে পারে না। তাই সংগঠন হলেই শুধু চলবে না আদর্শবাদীও হওয়া চাই।


সমাজ বিপ্লবের কাজ যেহেতু খুব সহজসাধ্য নয় তাই নানা বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সমাজ বিপ্লবের একজন কর্মীকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে হয়। বস্তুবাদী আদর্শে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত নিজের সততা ও বিশ্বস্ততাকে ধরে রাখতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবেই ছুটেন তিনি ক্ষমতা, খ্যাতি ও প্রাপ্তির সন্ধানে। রাজপথের শ্লোগান তখনই ইথারে উবে যায় বুঁদবুদের মতো, আন্দোলন ঝরানো রক্ত মুখথুবড়ে পড়ে থাকে রাজপথে। আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামোতেই এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।


একমাত্র ইসলামই পারে
একমাত্র ইসলামী আদর্শই একজন মানুষের চরম বিকাশের দায়িত্ব নিতে পারে। মানবতার বিকাশের দুয়ার এখানে এত অবারিত যে, একজন নিজেকে আল্লাহ পর্যন্ত (ফানাফিল্লাহ) পৌঁছে দিতে পারে। একজন ইসলামে বিশ্বাসী ব্যক্তি সব সময়ই আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার মানসিকতায় একদিকে সদা জাগ্রত ও সতর্ক থাকেন- যাতে তার দ্বারা কোন অন্যায় হয়ে না যায়, তেমনি অন্যদিকে কেউ যদি তার অবদানের স্বীকৃতি না দেয় তবুও চূড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জীবনের চরম ত্যাগ স্বীকার করে যেতে পারে নির্দ্বিধায়, অকুণ্ঠচিত্তে।

ইসলামী সংগঠন
সমাজ বিপ্লবের জন্য যেমন ইসলামী আদর্শের কোন জুড়ি নেই, তেমনি ইসলামী আদর্শের আলোকে গড়ে ওঠা সংগঠনই পারে সত্যিকার মননশীলতা, নৈতিকতা ও মানবিকতার (গড়ৎধষরঃু ধহফ ঐঁসধহরঃু) অপরিহার্য গুণাবলী বিকাশের দায়িত্ব নিতে।


ছাত্র মজলিসের আত্মপ্রকাশ
ছাত্র মজলিস উপরোক্ত বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে এক ঐতিহাসিক ও অনিবার্য প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই আত্মপ্রকাশ করেছে। ছাত্র মজলিস শুধু পর্যালোচনাই করেনি, পর্যালোচনার দাবি পূরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আন্দোলনের নাম যদি গতিশীলতা হয়, তাহলে ছাত্র মজলিস এই নিরন্তর গতি প্রবাহেরই ঐতিহ্যবাহী এক বিকশিত ধাপ। বিমানের আরোহী যদি ভূমিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাহলে হয়ত সে দেখতে পারে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক উপরে আছে। কিন্তু চন্দ্রজয়ী অভিযাত্রীর জন্য তা কখনো আত্মতৃপ্তির কারণ হতে পারে না। ছাত্র মজলিসের দৃষ্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যপানে নিবদ্ধ।
এ ছাড়া এদেশে ইসলামী আন্দোলনের আরও কিছু অতীত অভিজ্ঞতা ছাত্র মজলিসের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।


ইসলামী আন্দোলনের অতীত ঐতিহ্য
ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হঠাৎ করে জেগে ওঠা কোন জযবা বা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান নয়। খেলাফতে রাশেদার পতনযুগ থেকেই ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলে আসছে। আমাদের মহান “ইমাম” ও “সলফে সালেহীনগণ” যুগে যুগে এ আন্দোলন সংগঠনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। হযরত ইমাম হুসাইনের (রাযি.) শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে ‘মাইলফলক’ হয়ে থাকবে। এ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নানান ঘাতপ্রতিঘাত ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, উপমহাদেশে মুজাদ্দিদে আলফেসানী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ.), শাহ আবদুল আজীজ, হাজী শরীয়ত উল্লাহ দুদু মিয়া (রহ.), তিতুমীর (রহ.) সহ আরও অনেক মনীষীর নেতৃত্বে বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সর্বশেষে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও মাওঃ আবদুর রহীম (রহ.) ইসলামী সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের যে ঐতিহ্যবাহী ধারার সৃষ্টি করেছেন, ইসলামী ছাত্র মজলিস এই ক্রমবিকাশমান ধারারই নবতর সংযোজন।

 

ইসলামী বিপ্লবের আন্দোলনে ওলামাদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ
হাদীস অনুসারে আলেমরাই হচ্ছেন নবীদের উত্তরাধিকার। ইসলামী আন্দোলনে ওলামাদের নেতৃত্ব অপরিহার্য। নবীগণ থাকলে তাঁরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করতেন। তাছাড়া এদেশে ইসলামী আন্দোলনে ওলামাদের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এ আন্দোলন কখনো গণরূপ ও সফলকাম হতে পারবে না। অথচ দুঃখজনক অভিজ্ঞতা এই যে, বর্তমান অর্ধশতাব্দী যাবৎ ইসলামী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মকাণ্ডে ওলামাদের অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তদুপরি তাদের প্রতি একটা ক্ষীণ ঘৃণাবোধও ইসলামী আন্দোলনের পরিমণ্ডলে যেকোন কারণেই হোক চালু হয়ে গেছে। দু’টি ধারার দু’মুখী স্রোতের পরিণাম ইসলামী আন্দোলনের সফলতার পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামী বিপ্লবের ঝাণ্ডাবাহী সংগঠনকে এই জিহাদে ওলামাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের সাংগঠনিক পরিবেশ ও নেতৃত্ব মেনে নেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। ছাত্র মজলিস এ দু’ধারার সমন্বয়ে ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপক গণভিত্তি তৈরি করতে চায়।


গণ-আন্দোলনের ধারণা
বিপ্লবের জন্য গণ-আন্দোলনের প্রক্রিয়াই যথার্থ ও পরীক্ষিত। স্বৈরাচার, তাগুত, জালেম ও প্রতিষ্ঠিত শক্তির সাথে কোনরূপ আপোস বা প্রচ্ছন্ন লিয়াজোঁর মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্যই ইসলাম কায়েম করতে হবে। আর জালেম স্বৈরাচাররা জনতার অধিকারকে কুক্ষিগত করেই ক্ষমতায় টিকে থাকে।

কুরআনের ঘোষণা- “তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ নির্যাতিত নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরা আর্তনাদ করে বলছে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই জালেম স্বৈরাচারের জনপদ থেকে উদ্ধার করো।”

সুতরাং গণ-আন্দোলন ছাড়া জালেম, স্বৈরাচারের পতন এবং ইসলামী বিপ্লব সম্ভব নয়। ছাত্র মজলিস গণ-আন্দোলনের ভিত্তি রচনার লক্ষ্যে আপোসহীন কাজ করবে।

ইসলামীকরণ ও ইসলামী বিপ্লব
অনেকে ইসলামীকরণকেই ইসলামী বিপ্লবের কাজ বলে ভুল করেন। অথচ দুটো সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। এ পর্যন্ত ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় অনেক কাজই হয়েছে। এটাকে আমরা ইসলামের খেদমতী রূপ বলতে পারি। কিন্তু এ পদ্ধতিতে কখনো ইসলামী বিপ্লব হতে পারে না। ছাত্র মজলিস এসব খেদমতকেও গৌরবের সাথে সমন্বয় কামনা করে। কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা হচ্ছে দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“রসূলকে পাঠানো হয়েছে বাতিল সব মতবাদের উপর ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।” (সূরা সফ: ৯)


দলীয় সংকীর্ণতা
দলীয় সংকীর্ণতা ইসলামী আন্দোলন সফলতার পথে বড় প্রতিবন্ধক। অথচ অনেকেই এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। কেউ কেউতো অন্যান্যদের কাজকে স্বীকৃতি না দিয়ে নিজেরাই একমাত্র হওয়ার সদম্ভ ও অযাচিত আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। এ রকম দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সকলের ঐক্যপ্রয়াসে কাজ করতে না পারলে ইসলামী শক্তি সমন্বিত সত্তারূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। ছাত্র মজলিস ইসলামী শক্তির ঐক্যপ্রয়াসকে জোরদার করবে।


ইসলামী ছাত্র মজলিসের আহ্বান
ছাত্র মজলিস চায় জালেম, স্বৈরাচার তাগুতী শক্তির অপসারণ ঘটিয়ে এ জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্য প্রয়োজন একদল যোগ্যকর্মী ও আত্মনিবেদিত মর্দে মুজাহিদের, যারা সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ চরিত্রে নিজেদেরকে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত করবে। বর্তমান জাহেলী সমাজে এই কাজ সুকঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তাই ইসলামী সমাজ বিপ্লবের একজন পূর্ণাঙ্গ সৈনিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ছাত্র মজলিস জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন এবং গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে কাজ করবে। এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে সকল প্রকার আপোসহীনতা ও আদর্শহীনতার প্রেক্ষাপটে ছাত্র মজলিস গঠনমূলক ও সংগ্রামী ধারার সূচনা করবে। আমরা সত্যান্বেষী সকলকে জীবন গঠন ও সমাজ বিপ্লবের এই জিহাদে শরীক হয়ে পরকালীন মুক্তির পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাব।


ছাত্র মজলিস তাই আত্মপ্রকাশের লগ্নেই ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জাতীয় জীবনে আদর্শ ও মূল্যবোধের সংকট, ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনা ও সমস্যা, ইসলামী শক্তিসমূহের ঐক্য ও সমন্বয় সাধন এবং ইসলামী আন্দোলনের অতীত অভিজ্ঞতা প্রভৃতি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে এবং এর নিরিখে ইসলামী বিপ্লবের জন্য একদল আপোসহীন, গণ-আন্দোলনে বিশ্বাসী, ত্যাগী অথচ উজ্জ্বল চরিত্রসম্পন্ন কর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে একটা বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হয়। ৫ জানুয়ারি ‘৯০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে রাত সাড়ে ন’টায় ঘোষণা করা হয় “আমরা নিরব হবো না, নিথর হবো না, নিস্তব্ধ হবো না, যতদিন না মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে একটা জীবন্ত শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাবো।”


মিনারের পাদদেশে গ্রন্থিত এই শপথের বাণী ভোরের আযানের সাথে সহস্র কণ্ঠ হয়ে ছড়িয়ে গেলো সারা বাংলায়, পৃথিবীতে। ঘুমন্ত, তন্দ্রাচ্ছন্ন পৃথিবী জেগে উঠে দেখলো আরেকটা নবতর সূর্যোদয়। শুনতে পেলো নতুন চেতনায় জাগরিত একদল তরুণ মুজাহিদের আপোসহীন শপথের কোরাস।

 

সমাপ্ত